জাতীয়

কঠিন বাস্তবতার মুখে কর্মহীন মানুষ

টানা দুই বছর ধরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চলায় দেশের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। গত দুই অর্থবছরে অর্থনীতিতে এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে গত ২৯ জুন সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছোট ছোট শিল্পকারখানা বন্ধের পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জীবনেও নেমে এসেছে অন্ধকার। এ সময়ে দেশে নতুন কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি উল্টো চাকরি হারিয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। কাজ হারিয়ে বেকার ও আগে থেকে চাকরিপ্রত্যাশী- এ বিপুলসংখ্যক মানুষের কাজের সংস্থান করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এমন কঠিন বাস্তবতা থেকে উত্তরণে নতুন বাজেটে সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনাও ঘোষণা করেনি সরকার।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন। আবার চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই- এমন মানুষের সংখ্যা আরও অনেক। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ কর্মজীবীর বেতন কমেছে।

এদিকে গত দেড় বছর ধরে দেশে সরকারি চাকরির নিয়োগ কার্যক্রমও পুরোপুরি বন্ধ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এর অধীনস্ত দপ্তরগুলোতে প্রায় চার লাখ শূন্য পদ আছে। এসব পদের বিপরীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেও করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে বারবার লকডাউন ঘোষণার কারণে পরীক্ষা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ তো হচ্ছেই না, উল্টো অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই চলছে। ফলে চাকরিপ্রার্থীদের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড ১৯-এর কারণে বাংলাদেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এ এমএসএমই প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রায় দুই কোটি নারী-পুরুষ এ খাতে কাজ করেন। আইএফসির এ সমীক্ষা আরও এক বছর আগের। আর শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, করোনার কারণে তৈরি পোশাক খাতের কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ভাষ্য, করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে ঝুঁঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। সংস্থাটির হিসাবে, সবাই যদি পূর্ণকালীন কাজ করতেন (সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা), তা হলে বাংলাদেশে করোনায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছেন।

গত ৪ জুন চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি তরুণ, যার হার উন্নত বিশ্বে ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি নয়। এ ছাড়া প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। তবে বাজেট বক্তৃতায় শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো রূপরেখা দেননি অর্থমন্ত্রী। ফলে বিপুল বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের বিষয়টি সরকারের পরিকল্পনার বাইরেই থেকে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, পুরো পৃথিবীতেই এখন কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি হয়েছে, লোকজন চাকরি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশে আগেও চাকরির সংকট ছিল। কোভিডের কারণে সে সংকট আরও বেড়েছে। ফলে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের চাকরির পেছনের না ছুটে বিকল্প পেশা খুঁজতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তারা যদি কৃষিতে মনোযোগ দেয়, তা হলে আমাদের কৃষি খাত বড় সাফল্য পাবে। তরুণদের কর্মসংস্থানও হবে। কিন্তু আমাদের তরুণ-তরুণীদের মানসিকতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তারা অফিস-আদালতের চাকরিতেই বেশি মনোযোগী। হাতে মাটি লাগবে এমন কাজ করতে তারা অনাগ্রহী। এ মানসিকতার পরিবর্তন খুবই জরুরি, তা হলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান হবে।

তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতি ঠিক হলেও সহজে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরি হবে না। কারণ যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন কর্মী ছাঁটাই করছে, সেসব প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়ালে তারা তাদের পুরনো কর্মীদেরই আবার নিয়োগ দেবে। ফলে নতুনদের জন্য কর্মসংস্থানের বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে।

চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলো স্থবির হয়ে থাকা প্রসঙ্গে আইএলওর সাবেক কনসালট্যান্ট ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, করোনা পরিস্থিতি যদি আরও দু-তিন বছর অব্যাহত থাকে তা হলেও কি নিয়োগ বন্ধ থাকবে? কোভিডের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নেওয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষিতদের জন্য চাকরির বাজার আগে থেকে সংকুচিত। আমাদের এখানে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকের ব্যাপক অভাব। এ জন্য কোভিডসহ যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কারিগরি শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিতেই হবে। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের চাকরির বিকল্প চিন্তা করারও সময় এসেছে। তারা তাদের পরিবারিক কৃষিতেও যোগ দিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পারে। তবে এসব কাজের জন্য তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

করোনাকালে কাজ হারানোদের জীবিকা কীভাবে চালু রাখা যেতে পারে এমন প্রশ্নে ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, যারা কাজ হারিয়েছেন বা ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা চালাতেন স্বল্প মেয়াদে তাদের সরকারের তরফ থেকে খাদ্য সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ হঠাৎ করে এ সময়ে তাদের কর্মসংস্থানে নেওয়া যাবে না। তবে মধ্য মেয়াদে অবশ্যই সরকারকে ব্যবসা-বাণিজ্য চালুর দিকে যেতে হবে। সাময়িক বিচারে যেমন অনলাইন কেনাকাটাভিত্তিক ব্যবসাগুলোও চালু রাখতে হবে। আর যারা দিনমজুর তাদের খাদ্য সহায়তাও দিয়ে যেতে হবে। এ মুহূর্তে নতুন চাকরির বাজার তৈরি করা সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্যই কঠিন।

তিনি বলেন, সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে মানুষকে তাদের বর্তমান কর্মেই যুক্ত রাখা জরুরি। কারণ কাজ হারানো বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হঠাৎ করে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে দেশের সব মানুষকেই যত দ্রুত সম্ভব টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তা হলে সমস্যার সমাধান মিলবে সহজেই।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button