জাতীয়

করোনায় কোরবানি ও গ্রামীণ অর্থনীতি

দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ছে। যা ইতোমধ্যে সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। করোনার সংক্রমণ রোধে সারাদেশে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করছে সরকার। করোনায় প্রান্তিক জনপদের মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। বহু মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার। দৈনিক উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো কঠোর লকডাউনের কারণে চরম অর্থ সংকটে পড়েছে। সরকার ইতোমধ্যে প্রান্তিক জনপদের খেটে খাওয়া কর্মহীন মানুষ ও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ২৩ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, তবে তা একেবারেই অপ্রতুল।
সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে দেশের দুস্থ ও গরিব, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, বয়স্ক নারী-পুরুষ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করে থাকে। যদিও পরিমাণে তা খুবই কম। এসব ভাতা গ্রহীতার তালিকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে তৈরি করা হয়ে থাকে। এই তালিকা তৈরিতে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। এ ক্ষেত্রে যদি প্রকৃত দুস্থদের ডাটাবেজ তৈরি করা যেত, তাহলে এ খাতের দুর্নীতি বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব হতো। এ লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে গরিব, অসহায় ও দুস্থ মানুষের একটি ডাটাবেজ তৈরি করার দায়িত্ব অর্পণ করলেও সে কাজ এখনও শুরুই করা যায়নি। গবেষণা বলছে, করোনায় নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দেশের কৃষি খাত ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। তাই যেসব চাকরিহারা কর্মহীন মানুষ নতুন করে বাঁচার আশায় কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেছে। তাদের এনজিওর মাধ্যমে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা গেলে কৃষিই হতে পারে কর্মসংস্থানের নতুন সর্ববৃহৎ খাত। এ খাতে বিনিয়োগ সহজীকরণ করতে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ছোট-বড় এনজিওর মাধ্যমে এসএমই লোন প্রদান করা যেতে পারে। এতে করে একদিকে যেমন গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি সচল হবে, অন্যদিকে কৃষিতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার দু’সপ্তাহও বাকি নেই। ঈদ উপলক্ষে দেশের খামারিরা প্রস্তুত। তাদের খামারে লাখ লাখ গরু-ছাগল বিক্রির অপেক্ষায়। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। সরকার বা সংশ্নিষ্টরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। গ্রামের হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করা না গেলে দেশের অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এদিকে, দেশীয় খামারিদের কথা চিন্তা করে ভারতীয় গরু আমদানি রোধে আগে থেকেই ভারত সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। ভারত থেকে চোরাই পথে গরু আমদানি হলে দেশে করোনার ভয়াবহতা যেমন বাড়তে পারে, তেমনি লোকসানের মুখে পড়তে পারে দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক খামারিরা, যা করোনাকালে গ্রামীণ অর্থনীতিকে কঠিন চাপে ফেলবে। সুতরাং চোরাই পথে গরু প্রবেশ ঠেকাতে এখন থেকেই তৎপর থাকতে হবে।
এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও সরকার ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু গত দু-তিন বছর কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নিয়ে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা দুঃখজনক। চামড়া দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সঠিক তদারকির অভাবে এবং অব্যবস্থাপনার কারণে কোরবানিকেন্দ্রিক চামড়া শিল্প হুমকির মুখে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়, তার অধিকাংশই হয় কোরবানির সময়ে। কোরবানির চামড়ার দাম দেশে কম হলেও দেশে-বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশ চড়া। একশ্রেণির ফড়িয়া ও মুনাফাখোর সিন্ডিকেট তৈরি করে পুরো চামড়া বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা ইচ্ছামতো দাম কমিয়ে-বাড়িয়ে গরিবের হকে ভাগ বসায়, যা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধও। বাজার সমন্বয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। মুনাফাখোর অসাধু কারবারিদের হাত থেকে রপ্তানিযোগ্য চামড়া শিল্পকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে কাঁচা চামড়ার ক্রেতা খুঁজে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে। গত বছর পশুর চামড়ার দাম ছিল যথাক্রমে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ও ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সে হিসাবে দাম কমেছে ঢাকায় ১০ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৮ টাকা।
কাঁচা চামড়া পরিবহনে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। ব্যাংক সময়মতো টাকা দেয়নি বা আড়তদাররা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বকেয়া টাকা সময়মতো পরিশোধ করেনি- এই ঠুনকো অজুহাতে কোনো পক্ষই যাতে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে পশুত্ব করতে না পারে, সে বিষয়ে সব পক্ষ আন্তরিক থাকবে বলেই বিশ্বাস। চামড়া কারবারিদের একটি কথা মনে রাখা দরকার, কোরবানির চামড়ার বিক্রীত টাকা দিয়ে সারাবছর দেশের অগণিত এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে অবস্থানরত এতিম ও গরিবদের খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে। তাই জাতি প্রত্যাশা করে, সংশ্নিষ্ট সব পক্ষ মানবিকতার নজির স্থাপন করবেন। চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে প্রকৃত দামে চামড়া কেনাবেচা করবেন।
অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button