ঢাকার রাস্তায় নামছে মানুষ, বাড়ছে গাড়ি
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ প্রথম দিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলেও দিন যত যাচ্ছে ততই বিধিনিষেধ উপেক্ষার প্রবণতা বাড়ছে। সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে কঠোর মনোভাব দেখা গেলেও ক্রমেই তা ঝিমিয়ে পড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ও মোড়ে র্যাব-পুলিশের তল্লাশি চৌকি প্রথম দিকে যেমন ছিল, এখনো আছে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরব উপস্থিতিও আছে যথারীতি; কিন্তু সরকারের বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে তৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছে কম।
নগরবাসীর অবস্থাও তথৈবচ। প্রথমদিকে যে সচেতনতার লাগাম ছিল, ক্রমেই তাতে ঢিল পড়ছে। সড়কে সড়কে বেড়ে গেছে নাগরিক বিচরণ। রাজধানীর প্রায় সর্বত্র আরও একটি বিষয় ছিল বিশেষ লক্ষণীয়- দোকানপাট খোলা রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্যরত সদস্যদের সঙ্গে চলেছে লুকোচুরি খেলা। দূরে র্যাব-পুলিশের গাড়ি দেখামাত্রই দোকানের ঝাপ পড়ে যাচ্ছে, গাড়ি চলে গেলে ফের খুলছে ঝাপ; ফের মানুষের ভিড়।
কঠোর লকডাউনের চতুর্থ দিন ছিল গতকাল সোমবার। এদিনও সকাল থেকে রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সঙ্গে মাঠে ছিল সেনাবাহিনী; কিন্তু আগের তিনটি দিনের তুলনায় গতকাল অনেক বেশি নগরবাসীকে সড়কে দেখা গেছে। শুরুতে শুধু রিকশা দেখা গেলেও গতকাল প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের চলাচল বাড়তে দেখা গেছে।। সড়কের অনেক স্থানে ভাসমান দোকানও দেখা গেছে। এ তো গেল মূল সড়কের চিত্র। পাড়া-মহল্লায়, অলি-গলিতে কিন্তু আগের দৃশ্যই রয়ে গেছে। অসচেতন মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-কিশোরদের আড্ডাবাজি চলেছে নির্বিঘ্নে।
জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া বেশিরভাগ মানুষকেই গতকালও গন্তব্যে যেতে হয়েছে হেঁটে। আর রিকশায় বা ভ্যানে উঠলে গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। মহানগরীর কাঁচাবাজারগুলো খোলা থাকলেও ক্রেতা ছিল কম।
মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের ভাষ্য- কিছু মানুষ জরুরি কাজে বের হলেও অধিকাংশই বিধিনিষেধ অমান্য করে বের হচ্ছেন। চেকপোস্টে প্রত্যেকেই বলছেন, ‘জরুরি কাজে’ বের হয়েছেন; কিন্তু বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেখাতে পারেননি অধিকাংশ পথচারী। যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় গতকালও অনেককেই গুনতে হয়েছে জরিমানা, মুখোমুখি হতে হয়েছে মামলার।
গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, পল্লবী, রামপুরা, খিলগাঁও, গাবতলী, টেকনিক্যাল, আদাবর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, গুলশান, মহাখালী, মালিবাগ, বাড্ডা, প্রগতি সরণি, নতুনবাজার, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ জানিয়েছে, গতকাল রাজধানীতে বিধিনিষেধ অমান্য করায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১৬৪ জনকে ১ লাখ ২৬ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এদিন ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ ৪৪৩টি গাড়িকে ১০ লাখ ২১ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে কর্তব্যরত কাফরুল থানার এসআই আব্দুল জলিল বলেন, মানুষ নানা অজুহাতে রাস্তায় বের হচ্ছেন। সবাই জরুরি প্রয়োজন বললেও কারণ দেখাচ্ছেন খুবই ঠুনকো। কেউ কেউ জেরার মুখে অদ্ভুত-অদ্ভুত কারণও বলছেন। এমনও দেখা গেছে, নগরীর নীরবতা উপভোগ করতে বা স্রেফ হাঁটতে বেরিয়েছেন; কেউবা এমনিতেই বেরিয়েছেন। তিনি বলেন, পাড়া-মহল্লায় অলি-গলির মুখে মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। টহল পুলিশের গাড়ি দেখলে বাসার ভেতরে ঢুকে যায়। গাড়ি চলে গেলে আবার বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়। এমন ঘটনায় পুলিশ কীভাবে নজরদারি করবে নিজে সচেতন না হলে?
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তেজগাঁও সাতরাস্তার কাছে বিজি প্রেসের সামনের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট মো. উজ্জ্বল হোসেন বলেন, সকাল ৯টার পর থেকে মানুষের চলাচল বেড়েছে। যারা বের হচ্ছেন, অধিকাংশই রোগী বা রোগীর স্বজন পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ কেউ কোভিড ১৯-এর টিকা বা পরীক্ষার জন্য বের হয়েছেন বলেও জানান। বিদেশগামী লোকের সংখ্যাও অন্য দিনের তুলনায় বেশি পাওয়া গেছে। ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান খোলা বলে সড়কে মানুষ বেড়েছে। তবে অনেকেই যৌক্তিক কারণ ছাড়া বের হচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সার্জেন্ট উজ্জ্বল জানান, তার চেকপোস্টে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৮ জনকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে পাওয়া গেছে, যিনি মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে বলেন, পেছনে বসা যাত্রী তার ভাই। জরুরি প্রয়োজনে অফিসে পৌঁছে দিতে যাচ্ছেন। পরে দেখা গেল তারা দুজনই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে তাদের এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এমন অনেকেই বের হওয়ার যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারেননি। এমন কাউকে পাওয়া গেলে সরকারি আদেশ অমান্য করার অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার মোড়ে সোমবার সকাল ১০টার দিকে র্যাব ১০-এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঘণ্টাখানেকের অভিযানে বিনাকারণে গাড়ি নিয়ে বের হওয়া বা মাস্ক ব্যবহার না করাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০ জনকে জরিমানা করা হয়। আগে-পরে যান ও মানুষের চলাচল বেশি থাকলেও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসার পর তাঁতিবাজার মোড় দিয়ে যান চলাচল কমে যায়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আকতারুজ্জামান বলেন, সকাল থেকেই র্যাব ১০-এর সহযোগিতায় মোবাইলকোর্টের কার্যক্রম চলছে। তাঁতিবাজার ও আশপাশের এসব এলাকা বাণিজ্যঅধ্যুষিত। পাশেই ওষুধের পাইকারি বাজার মিটফোর্ড। অভিযানকালে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষই ওষুধের দোকানের মালিক ও কর্মচারী বা ওষুধের ক্রেতা। কেউবা হাসপাতালে এসেছেন, রোগী বা স্বজন। ডকুমেন্ট দেখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো ব্যবসায়ী এলসি বা ব্যাংকে টাকা জমা করার জন্য এসেছেন। কেউ কেউ বিনা কারণেই বের হয়েছেন। তাদের আর্থিক জরিমানা করা হয়। জরিমানা করতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হয়েছে। কারণ, কাউকে কাউকে জরিমানা করা হলেও দেখা যায় তাদের আবার দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তিনি বলেন, আসলে মানুষকে জরিমানা করা নয়, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। সার্বিকভাবে এ স্পটে আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি দেখা গেছে।
সোমবার দুপুরে পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার মোড়ে শহীদনগর এলাকার একটি গলির মুখে কয়েক কিশোর বসে ছিল। হঠাৎ তাদের গলির ভেতরে ছুটে যেতে দেখা যায়। প্রথমে মনে হয়েছিল পুলিশ দেখে তারা ভয়ে পালিয়েছে; কিন্তু না। তারা গলির ভেতরের দোকানিদের বার্তা দিচ্ছে পুলিশের উপস্থিতির। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল একের পর এক দোকানের ঝাপ টানার শব্দ।
উর্দু রোডে মার্কেট ও দোকান সবই ছিল বন্ধ। প্রায় দোকানেরই সামনে এক-দুজন লোক বসা কিংবা দাঁড়ানো দেখা যায়। অপেক্ষার কিছু সময় পর দেখা যায়- এরা সবাই দোকানের মালিক কিংবা কর্মী। ক্রেতারা ফোন দিয়ে এলেই তাদের দোকানের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক ব্যবসায়ী বলেন, এখানকার প্রায় সবাই পাইকারি পণ্য বিক্রি করেন। সবার ক্রেতাও নির্ধারিত কিছু মানুষ। ক্রেতারা ফোন দিয়ে এলে তাদের মাল দেখানো হচ্ছে। পছন্দ হলে অর্ডার করবেন। পরে সুবিধামতো সময় ডেলিভারি দেওয়া হবে।
হরনাথ ঘোষ রোড ও চকবাজারে দেখা যায়, সড়কের দুপাশের দোকান বন্ধ। তবে গলির ভেতরের অনেক দোকানই খোলা। পাইকারি দোকানের গোডাউন থেকে খালাস হচ্ছে মালামাল। আজগর লেন ও চক সার্কুলার রোড ঘুরেও দেখা গেছে, কিছু দোকানের শাটার অর্ধেক নামানো। ক্রেতাও ঢুকেছেন দোকানে।
করোনার সংক্রমণ রোধে ঢাকার বাইরে থেকে অপ্রয়োজনীয় যানবাহনের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই বাবুবাজার ব্রিজের পূর্বদিকে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি ও মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন পুলিশের অপরাধ ও ট্রাফিক বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। তবু থেমে নেই ঢাকামুখী মানুষের ঢল। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বিকল্প কিছু অবলম্বন করে, কেউ কেউ হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসছেন।
সোমবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে নয়াবাজার ঢালে চেকপোস্টে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হয় কেরানীগঞ্জ থেকে আসা সোহেল নামের এক যুবককে। সোহেল জানান, চেক নিয়ে ব্যাংকে এসেছেন টাকা তুলতে। পুলিশ তার চেক পরীক্ষা করে তাতে কোনো নাম, তারিখ আর টাকার অঙ্ক পায়নি। কারণ জানতে চাইলে সোহেল বলেন, একজনের টাকা পাওনা তিনি। ওই লোক তাকে এই চেক দিয়েছেন। ব্যাংকে গিয়ে তাকে ফোন করে টাকার অঙ্ক জেনে চেকে বসিয়ে নেওয়ার কথা জানান; কিন্তু তার যুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি পুলিশ সদস্যরা। তাই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তল্লাশি চৌকির এক পাশে।
লালবাগ বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, ওই যুবক ভুয়া চেক নিয়ে কৌশলে বের হয়েছেন। ওই তল্লাশি চৌকিতে সোহেলের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, যারা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বেরিয়ে আটক হয়েছেন। সেখানে রিফাত নামে এক যুবক জানান, তিনি বংশাল থাকেন। কদমতলীতে বোনের বাসা থেকে ফেরার পথে পুলিশ তাকে আটক করেছে। লকডাউনে দূরপাল্লার সব যানবাহন থাকলেও শাকিল নামের আরেকজন জানান, তিনি সাতক্ষীরার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত আসার পর আটকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, যারা অতিপ্রয়োজনে বের হচ্ছেন, তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু ঠুনকো অজুহাতে যারা বের হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবার আগে নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বুঝতে হবে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা।
আপনি জানেন না লকডাউন চলছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ? এমন লকডাউনেও শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যেতে মন চায়? পুরান ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজের সামনে চেকপোস্টে কর্তব্যরত কোতোয়ালি জোনের পুলিশের সহকারী কমিশনার শারমিনা আলম এক ব্যক্তিকে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন শুনে এমন প্রশ্ন করেন। জরুরি এ লকডাউন পরিস্থিতিতে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার চেষ্টার অপরাধে তাকে আটক করা হয়।
শারমিনা আলম বলেন, লকডাউনের চতুর্থ দিনেও আমরা চেষ্টা করছি জনগণ যেন সতর্ক থাকে। যারা অকারণে বাইরে বের হয়েছেন তাদের প্রথমে বোঝানো ও পরবর্তীতে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে; কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, জনগণ এখনো সচেতন হয়নি। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পুলিশসহ সরকারের সর্বমহল থেকে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে; কিন্তু জনগণের মধ্যে সচেতনতার হার খুবই কম। সকাল থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এলে ডিএমপি অ্যাক্টে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অকারণে যারা ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের ঘরে ফেরানোই মূল কাজ।
এদিন রায়সাহেববাজার মোড়ে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে ১৫ জনকে আটক করে র্যাব-১০
গতকাল প্রগতি সরণি এলাকায় পুলিশের টহল দেখা গেলেও বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। এ ছাড়া লিংক রোড এলাকায় অনেক রাইডশেয়ার মোটরসাইকেলও দেখা যায়। রামপুরা ব্রিজে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ রিকশাচালক হাবিব বলেন, প্রথম কয়েক দিন রাস্তা ফাঁকা ছিল। এখন প্রাইভেটকার, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের অভাব নেই রাস্তায়। চেকপোস্টে খালি আমাদের জিজ্ঞাসা করে, প্রাইভেটকারওয়ালাদের কিছু বলে না পুলিশ। গুলশান গুদারাঘাটে যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন মোটরসাইকেলচালক সুজন দাস। তিনি বলেন, রাইডশেয়ারিং বন্ধ আছে ঠিক; কিন্তু আমাদের পেটের দায়ে বের হতে হয়েছে। এ ছাড়া রাস্তায় এখন সবাই বের হয়েছে। কেউ মাইক্রোবাসে যাত্রী নিচ্ছে, কেউ প্রাইভেটকারে যাত্রী নিচ্ছে। তা হলে আমরা নিলে সমস্যা কোথায়?
বিধিনিষেধে রাস্তায় গাড়ি ও মানুষ বের হওয়া সম্পর্কে মেরুল বাড্ডা পুলিশ চেকপোস্টে কর্মরত উপপরিদর্শক পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সকাল থেকেই তারা অনেককে ফিরিয়ে দিয়েছেন যুক্তিযুক্ত কারণ না থাকায়। তার পরও রাস্তায় অনেক মানুষ ও গাড়ি রয়েছে। তারা নিয়ম অমান্য করে চলাফেরা করছে। এই কঠোর বিধিনিষেধ মানুষকে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। মানুষ সচেতন না হলে প্রশাসনের পক্ষে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে।
সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় মুদি, মোবাইল বিল রিচার্জ, লন্ড্রি, ইলেক্ট্রনিক্সসহ বিভিন্ন পণ্যের বেশকিছু দোকান খোলা দেখা গেছে। তবে বেশিরভাগ দোকানের শাটার ছিল আধাখোলা। এ সময় হঠাৎ বাইরে একজন চিৎকার করে উঠলেন- আইছে, আইছে। প্রায় এক ছন্দে একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে দেখা যায় সব খোলা দোকানের শাটার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফল, সবজি বিক্রি করা ফেরিওয়ালারাও ভ্যান নিয়ে সরে যান গলির ভেতর। পরমুহূর্তেই ওই সড়কে দেখা যায় মোহাম্মদপুর থানার একটি টহল গাড়ি। মোহাম্মাদীয়া হাউজিং এলাকায় টহল দিয়ে কালভার্ট পার হয়ে সেই গাড়ি গেল লোহারগেট এলাকার দিকে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার মিনিটখানেক পর আবার উঠে গেল দোকানের শাটার। কিছু দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন আটকাপড়া ক্রেতারা। ঈদের পর শুরু হওয়া ‘কঠোরতম লকডাউন’-এর চতুর্থ দিন সোমবার পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরির এমন চিত্র ছিল রাজধানীর প্রায় সর্বত্রই।
মোহাম্মাদীয়া হাউজিং এলাকার মুদি দোকান নূরজাহান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক শফিকুল আলম বলেন, পুলিশ এলে কিছু করার থাকে না। তারাতো কথা শুনতে চায় না। আমাদের দোকান নিত্যপণ্যের; কিন্তু তারা বন্ধ করতে বলে। আমাদেরতো টিকতে হবে। মানুষেরও কেনাকাটার দরকার আছে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পর পাশেই আরেক দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন ক্রেতা আমজাদ ইসলাম। তিনি বলেন, টুকটাক জিনিস কেনার ছিল; কিন্তু পুলিশ দোকান বন্ধ করে দিলেতো কিছুই করার থাকে না। খোলা থাকলেই বরং সুবিধা। এই যেমন- আমি বদ্ধ জায়গায় মিনিটখানেক ছিলাম, এটাতো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
মিরপুরের রূপনগর এলাকার মহল্লাগুলোতেও মোহাম্মদপুরের মতো প্রায় একই অবস্থা দেখা যায় গতকাল। মোড়ে আড্ডা দিতে থাকা কম বয়সীদের জটলা থেকে টহল পুলিশ দেখলেই এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে শিষ দিয়ে কিংবা ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে পুলিশ আসার খবর। এর পর সুবিধামতো জায়গায় সরে যাচ্ছে তরুণ-যুবাদের দল। আবার পুলিশ চলে গেলেই হইহুল্লোড় করছে। তাদের বেশিরভাগের মুখে মাস্ক নেই।
রূপনগর থানার এসআই দেবরাজ চক্রবর্তী বলেন, সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে আমরা বেশি কিছু করতে পারি না। স্থানীয় ছেলেরা আমাদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলছে। আমরা এক দিকে গেলে তারা দৌড়ে অন্য দিকে গিয়ে চিল্লাচিল্লি করে, যেন আমাদের পাগল পেয়েছে। তার পরও আমরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে ডিউটি করার চেষ্টা করছি।
সিদ্ধেশ্বরী এলাকার অলি-গলিতেও বেশিরভাগই ছোট ছোট দোকানপাট খোলা ছিল শাটার অর্ধেক বন্ধ রেখে
নিত্যপণ্যের দোকান নয়- এমন কিছু দোকান লালবাগ রোডে ও চকবাজারে খোলা দেখা গেছে। অলিগলিতে ভ্যানগাড়িতে ফল আর সবজির পসরার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আনাগোনা ছিল অন্য দিনের তুলনায় বেশি। লকডাউনের প্রথম দুই দিন খাবারের হোটেল বন্ধ থাকলেও এখন খোলা, সামনে নাস্তার জন্য ভিড়। লালবাগ চৌরাস্তা, ঢাকেশ্বরী, পলাশীর মোড় ও বকশিবাজারে অলিগলিতে মানুষের চলাচল দেখা গেছে। চুড়িহাট্টার হায়দার বক্স লেনে গিয়ে দেখা গেছে এলাকা প্রায় জনমানবশূন্য।
তবে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, হাতিরপুল, গ্রিন রোড এলাকায় সড়কজুড়ে রয়েছে রিকশা, চলছে ব্যক্তিগত গাড়িও। তবে এসব এলাকায় সাইরেন বাজিয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চলতে দেখা গেছে অনেক বেশি। গ্রিন রোড এলাকার রিকশাচালক মো. কাইয়ুম বলেন, সকালে লকডাউন অনেকটা কঠোর থাকলেও সন্ধ্যার পর পর চলাচল সহজ হয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে লকডাউনে লোকজন বেশি বের হচ্ছে।