জাতীয়

দেশে করোনাভাইরাসের ৩৪টি স্বতন্ত্র রূপ

বাংলাদেশে সার্স কভ-২ বা করোনাভাইরাসের ৪ হাজার ৬০৪ রকম পরিবর্তিত রূপ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা, যার ৩৪টি একেবারেই আলাদা। অর্থাৎ এই ধরনগুলোর সঙ্গে বিশ্বে পাওয়া অন্য কোনো ধরনের মিল নেই। দেশে করোনাভাইরাসের যে রূপগুলো পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে ইউরোপের ধরনগুলোর মিলই বেশি পাওয়া গেছে গবেষণায়।
সার্স কভ-২-এর জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশি একদল গবেষকের গবেষণাপত্রটি গত শনিবার গবেষণা সাময়িকী ‘এলসেভিয়ার’ এবং নেদারল্যান্ডসের জার্নাল ‘ভাইরাস রিসার্চ’–এ প্রকাশিত হয়। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ডেটাবেইস ‘গ্লোবাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স অ্যান্ড রেসপন্স সিস্টেমে’ জমা হওয়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংক্রমিত করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সগুলো নিয়ে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
এক বছরের বেশি সময় আগে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বিশ্ব মহামারি বাধিয়ে দেওয়ার পর অসংখ্যবার রূপ বদলেছে, যাকে বলা হয় মিউটেশন।
বাংলাদেশে ভাইরাসটির ৩৪টি পরিবর্তিত ধরনকে গবেষকেরা বলছেন ‘বাংলা মিউটেশন’। গবেষকেরা বলছেন, এই মিউটেশনগুলো পাওয়া গেছে বেশি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে। তবে বৈচিত্র্যময় জিনোম সিকোয়েন্স পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চট্টগ্রামে সংক্রমিত ভাইরাসের জিনোমের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার ভাইরাসের জিনোমের মিল পাওয়া গেছে। আর দেশে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে ইউরোপের রূপগুলো। এ ছাড়া সার্স কভ-২-এর যে পরিবর্তনটিকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংক্রমণশীল বলে বিবেচনা করা হয়েছে, সেই ‘জি৬১৪ ডি মিউটেশন’ ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি সিকোয়েন্সের মধ্যেই ছিল।
জিনোম হলো জীবের জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এ বৈশিষ্ট্যের তথ্য জানার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো জিন নকশা উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং। আর জিনগুলো সজ্জিত হয় এডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থায়ামিন নামের চারটি ক্ষারক দিয়ে। এ ক্ষারকগুলো যখন ইতিপূর্বে পরিলক্ষিত অবস্থান থেকে পরিবর্তিত হয় এবং অন্য ক্ষারক দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়, তখন তাকে বলা হয় পরিবর্তন বা মিউটেশন। সার্স কভ-২ মূলত এভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে।
গবেষকদলের প্রধান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যে ৩৪টি ইউনিক মিউটেশন গবেষণায় পাওয়া গেছে, সেগুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যেসব রোগীর মধ্যে এ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ আছে, তাদের উপসর্গ ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ওপর নজর রাখতে হবে। কারণ, ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনের ফলে রোগী উপসর্গবিহীন হওয়া, নতুন উপসর্গ দেখা দেওয়া, জটিলতা বাড়িয়ে দেওয়া, ভাইরাসের সংক্রমণ করার ক্ষমতা বেড়ে বা কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো থাকে।’
দেশে এখন অক্সফোর্ডের কোভিড–১৯ টিকা দেওয়া হচ্ছে। নতুন মিউটেশন পাওয়া যাওয়ায় টিকার পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কি না, তা গবেষণা করে দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
গবেষকদলের অন্যতম প্রধান চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাসেল দাশ বলেন, বাংলাদেশের ‘ইউনিক’ মিউটেশনগুলো অঞ্চলভিত্তিক। কিছু জিনগত পরিবর্তন শুধু নির্দিষ্ট কিছু জেলা বা অঞ্চলেই দেখা গেছে। ঢাকায় তিনটি সুনির্দিষ্ট জিনগত পরিবর্তন দেখা গেছে। যেটি শুধু ঢাকার রোগীদের মধ্যেই ছিল। একইভাবে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বরিশাল, যশোর, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহে ভাইরাসের জেনেটিক ভিন্নতা ছিল। এ ক্ষেত্রে সেসব জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, জীবনযাপন এবং পরিবেশগত নিয়ামকগুলো হয়তো ভাইরাসের রূপবদলে ভূমিকা রেখেছে।
গবেষণার তত্ত্বাবধানে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম মাহবুবুর রশিদ ও ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জুনায়েদ সিদ্দিকি। উপাত্ত বিশ্লেষণে ছিলেন মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির হামিদ হোসাইন, নাজমুল হাসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন, রাশেদুজ্জামান ও মেহেদী হাসান।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button