বাংলাদেশ হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তিন মামলা, ৩ দিনের রিমান্ড
ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসা হেলেনা জাহাঙ্গীরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদে তিন দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ; রাতে দায়ের করা অপর দুই মামলাতেও রিমান্ড চাইবেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে শুক্রবার রাত ১২টার কিছু আগে রাজধানীর পল্লবী থানায় তৃতীয় মামলাটি দায়ের করা হয়।
পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে র্যাবের করা এই মামলায় শনিবার তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া হবে।“
রাজধানীর গুলশানের বাসায় বৃহস্পতিবার প্রায় চার ঘণ্টা অভিযানের পর র্যাব গ্রেপ্তার করে সম্প্রতি আলোচনায় আসা ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে।
‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি ‘ভূইফোঁড়’ সংগঠনের সভাপতি হওয়ার খবর চাউর হলে সম্প্রতি তাকে কমিটি থেকে বাদ দেয় আওয়ামী লীগ। এরপরই বেশ কয়েকটি অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র্যাব।
শুক্রবার রাত ১০টার কিছু আগে গুলশান থানায় দ্বিতীয় মামলা দায়েরের আগে সন্ধ্যায় এফবিসিসিআইর পরিচালক হেলেনা জাহাঙ্গীরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
পুলিশের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী এই আদেশ দেন ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই মামলাও হয় গুলশান থানায়। এরপর তাকে আদালতে হাজির করে থানা পুলিশ।
শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দেওয়ার পাশাপাশি আদালত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে দেয়।
এরপর হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে গুলশানে দ্বিতীয় মামলাটিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো একত্রিত করে দায়ের করা হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম।
রাতেই দ্বিতীয় মামলায় হেলেনাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরীর আদালতে। তবে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বিষয়টি পরে শুনানির জন্য রেখেছেন।
এফবিসিসিআইর পরিচালক হেলেনা জয়যাত্রা গ্রুপের কর্ণধার। জয়যাত্রা টেলিভিশনের চেয়ারপারসনের পাশাপাশি তিনি নিজেকে আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও পরিচয় দেন।
এই ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটিতে সদস্য ছিলেন। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগেরও উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন তিনি।
তবে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি ‘ভূইফোঁড়’ সংগঠনে হেলেনা জাহাঙ্গীরের সভাপতি হওয়ার খবর এলে সম্প্রতি তাকে দুই কমিটি থেকেই বাদ দেয় আওয়ামী লীগ।
হেলেনা এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কুমিল্লায় আব্দুল মতিন খসরুর আসনে উপনির্বাচনেও প্রার্থী হতেও চেয়েছিলেন তিনি। তবে কোনোবারই তিনি দলের মনোনয়ন পাননি।
‘আমি সরকারি লোক’- রিমান্ড শুনানিতে হেলেনা
র্যাবের অভিযোগ, নানা ধরনের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে সোশাল মিডিয়ায় ‘অপপ্রচার চালানোর একটি সংঘবদ্ধ চক্র’ গড়ে তুলেছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর।
শুক্রবার সন্ধ্যার পর এই অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ঢাকার হাকিম আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে পুলিশ।
অন্যদিকে হেলেনার পক্ষে আইনজীবী মো. শফিকুল ইসলাম রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, হেলেনা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মন্ত্রী, এমপি ও দেশের সম্মানিত নাগরিকদের বিরুদ্ধে ‘কটূক্তি করে’ ‘সরকারের ভাবমূর্তি ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন’।
অন্যদিকে তার আইনজীবী বলেন, “যার সম্মান নষ্ট করা হয়েছে শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন। অন্য কেউ এই মামলা করতে পারবেন না।”
তিনি যুক্তি দেন, “এজাহারে কোথাও কোনো উল্লেখ নাই, কখন কোথায় কীভাবে কার বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। আসামি একজন সিআইপি, এই মামলায় রিমান্ড কী দরকার? রিমান্ডের কোনো যুক্তি নাই।”
হেলেনা জাহাঙ্গীর এ সময় বলেন “আমি সরকারি লোক, আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ২৫টি দেশ সফর করেছি। আমি কেন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাব?”
তখন প্রমাণ হিসেবে একটি অডিও (মোবাইলের কলরেকর্ড) আদালতে উপস্থাপন করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু। সেই রেকর্ড আদালতে বাজিয়ে শোনানো হয়।
শুনানি শেষে বিচারক হেলেনার জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে তিন দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন পুলিশকে।
যত অভিযোগ
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার গুলশানে হেলেনার বাড়িতে অভিযানের পর মিরপুরে তার মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপিটিভির কার্যালয় এবং জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন ভবনেও অভিযান চলে।
রাতের অভিযান শেষে র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, হেলেনার বাসায় ‘মদ, হরিণের চামড়া, ক্যাসিনো বোর্ড, ওয়াকিটকিসহ বেশ কিছু অবৈধ সরঞ্জাম’ মিলেছে।
আর মিরপুরে অভিযান শেষে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাদির শাহ বলেন, জয়যাত্রা টিভির ‘কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না’।
হেলেনার বিরুদ্ধে মাট পাঁচটি মামলা হবে জানিয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ওয়াকিটকি পাওয়ায় টেলিযোগাযোগ আইনে, ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে, মদ পাওয়ায় মাদক আইনে, হরিণের চামড়া পাওয়ায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে এবং বিভিন্নভাবে ‘অপপ্রচার চালানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে।
সোশাল মিডিয়ায় ‘অপপ্রচারের চক্র’ গড়েছিলেন হেলেনা: র্যাব
হেলেনা নানা ধরনের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে সোশাল মিডিয়ায় ‘অপপ্রচার চালানোর একটি সংঘবদ্ধ চক্র’ গড়ে তুলেছিলেন বলে অভিযোগ করেছে র্যাব।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মঈন বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর স্বীকার করেছেন, তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মানহানি ও সুনাম নষ্ট করেছেন।
“নিজের খ্যাতি লাভের আশায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে খ্যাতনামা হিসাবে উপস্থাপন করতে চাতুরির আশ্রয় নিতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর।”
হেলেনা জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পেয়েছেন দাবি করে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন “উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করে ফেইসবুক লাইভে এসে অযাচিত এবং কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতেন।”
সংবাদ সম্মলনে বলা হয়, বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তিদের ‘কটাক্ষ করতেন’ হেলেনা। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ছড়িয়ে ‘অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেন’।
ইতোমধ্যে মিরপুরে ‘জয়যাত্রা টেলিভিশন’ সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “এই অননুমোদিত টেলিভিশনে কর্মী, সাংবাদিক নিয়োগের নামে হেলেনা জাহাঙ্গীর চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করতেন। চাঁদাবাজি সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি পাওয়া গেছে এবং সেগুলো জব্দ করা হয়েছে।”
ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে আসা হেলেনা ‘অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী’ ছিলেন বলে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, “তার অপকর্মের বিষয়ে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে র্যাব। প্রাথমিকভাবে তদন্তে হেলেনা জাহাঙ্গীর ২০টি ক্লাবের সদস্য বলে জানা গেছে।”
সেফুদার সঙ্গে ‘লেনদেন’ ছিল হেলেনার: র্যাব
সোশাল মিডিয়ায় নানা মন্তব্য করে আলোচনার জন্ম দেওয়া অস্ট্রিয়া প্রবাসী সেফাতউল্লাহ ওরফে সেফুদার সঙ্গে হেলেনা জাহাঙ্গীরের ‘যোগাযোগ ও লেনদেন’ ছিল বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, “সেফুদা তাকে (হেলেনা জাহাঙ্গীর) নাতনি হিসাবে সম্বোধন করে থাকে। তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এবং লেনদেন আছে।”
ফেইসবুক লাইভে বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে ২০১৮ সালে আলোচনায় আসেন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বসবাসকারী সেফুদা। ফেইসবুক লাইভে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকার আদালতে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছিল।
এক আইনজীবীর দায়ের করা ওই মামলায় সেফুদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তার সম্পত্তি জব্দেরও নির্দেশ দিয়েছিল আদালত।