জাতীয়

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

বিশ্বের সর্বত্রই দিন দিন চাহিদা কমছে চামড়াজাত পণ্যের। সুলভ ও টেকসই নানা বিকল্প পণ্যের দৌড়ে পেছনে পড়ে যাচ্ছে চামড়া। এর মধ্যেও দেশে এ শিল্পের পথচলা গত কয়েক বছর ধরে খুবই বাধাগ্রস্ত হয়েছে ট্যানারিশিল্প স্থানান্তর নিয়ে সৃষ্ট নানা টানাহেঁচড়ায়, মতভিন্নতায়। সব মিলিয়ে দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ খাতের অবস্থা যখন খুবই নাজুক, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো করোনার দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সম্ভাবনাময় এ খাতটি।

চামড়াশিল্পে বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানপূর্বক সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়ার অন্যতম আমদানিকারক চীন। লেদার পণ্যের পাশাপাশি সিনথেটিক এবং ফেব্রিক পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের একক বৃহত্তম দেশ চীন। বিকল্প এসব পণ্য উৎপাদন করায় এখন দেশটি আগের মতো বাংলাদেশ থেকে চামড়া নিচ্ছে না। পাশাপাশি তুলনামূলক কম দাম ও সুরুচিসম্মত হওয়ায় সিনথেটিক এবং ফেব্রিক দ্বারা উৎপাদিত জুতা, ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি পণ্যের কদরও বেড়েছে।

জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে চামড়াশিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি), ডি ওয়াটারিং ইউনিট, পাম্প, জেনারেটর ও ল্যাবের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সিইটিপি কার্যকর না থাকায় সব বর্জ্য গিয়ে ধলেশ^রী নদীতে পড়ে। ফলে দূষণের কারণে ধলেশ^রী নদীও এখন হুমকির মুখে। চামড়াশিল্প নগরে বর্জ্য ও পানি আলাদা করতে ডি ওয়াটারিং ইউনিট আছে ৯টি। তার মধ্যে তিনটি ইউনিটই অকার্যকর রয়েছে। অপ্রস্তুত চামড়া শিল্পনগরীতে কঠিন বর্জ্য (সলিড ওয়েস্ট) ব্যবস্থাপনা এবং ক্রোম রিকভারি ইউনিটের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। সিইটিপির

কাজ শেষ না করেই চীনা ঠিকাদার চলে গেছে। প্রায় দুই দশকেও এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব হয়নি। বিশ^ব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পওয়া যায়নি এখনো।

ট্যানারি উদ্যোক্তারা জানায়, ইউরোপ আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের কাছে সরাসরি চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ভালো ক্রেতাদের কাছে বিক্রিও করা যাচ্ছে না। অনেক ক্রেতা সাভারের চামড়া পল্লীতে এসে পরিবেশ খারাপ দেখে ফিরে গেছেন। এসব কারণে এ খাতের রপ্তানি দিন দিন কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১২৩ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নেমে হয় ১০৮ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও নেমে ১০২ কোটি ডলার। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি কাক্সিক্ষত মানের হয়নি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি হয়েছিল ৭৮ কোটি ডলারের। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রপ্তানি হয় ৮০.৯৬ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৭.৯৩ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫.০৫ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর যা রপ্তানি হয় তার মধ্যে চামড়ার তৈরি জুতাই ৮৫ শতাংশ। বাকি সিনথেটিকসহ অন্যান্য পণ্যের। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সূত্রে জানা যায়, বিশে^ জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। আর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ তে, অবদান ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে অতিমারী করোনার বিস্তৃতি ঘটলে চীন বাংলাদেশের প্রায় একশ কন্টেইনার রেডি/প্রক্রিয়াজাত করা চামড়ার চুক্তি বাতিল করে। ফলে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পকে একটি বড় অঙ্কের লোকসান শুনতে হয়। দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের যে চাহিদা রয়েছে তার একটি বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। দেশীয় চামড়াশিল্পের বিকাশে রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা পূরণ করা ও বাজার দখল করা সম্ভব।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চামড়া ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পেলেও ব্যাংক বকেয়া ঋণ কেটে রেখে দেওয়ায় তারা ঋণ করা সম্পূর্ণ অর্থ হাতে পান না। আবার অনেক চামড়া ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ নিয়ে চামড়া খাতে বিনিয়োগ না করে অন্য আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করায় চামড়াশিল্প ব্যাংক ঋণের প্রকৃত সুফল পাচ্ছে না।

এতে আরও বলা হয়েছে, ট্যানারিশিল্পে প্রতিদিন ১৭০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সাভারে ট্যানারি বর্জ্য শোধনের জন্য স্থাপিত কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। ফলে নতুন স্থাপিত কারখানাগুলো পরিবেশগত আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারছে না।

আবার হাজারীবাগ কারখানার মেশিনারিজ স্থানান্তর করা হলে তা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কায় অনেক ট্যানারি মালিক মেশিনারিজ স্থানান্তর না করে কারখানা বন্ধ রেখেছেন- বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

২০১৩ থেকেই দেশের চামড়ার বাজার ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে এবং ২০১৭ সাল থেকে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ওপর নিয়মিত বড় অঙ্কের আর্থিক লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ছিল ৮৫-৯০ টাকা। ২০২০ সালে সরকার একই মাপ ও মানের চামড়ার বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে ৩৫-৪০ টাকা। অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতা না পাওয়ায় এর থেকেও কম দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। গত তিন বছর ক্রেতা না পেয়ে অনেক চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। দেশের এ সম্ভাবনাময় বৃহত্তম রপ্তানিজাত পণ্যের এমন দৃশ্য অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ।

সূত্র জানায়, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য কমে যাওয়া এবং দেশীয় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় বিশ্ববাজারে চামড়াশিল্পের রপ্তানি আয় কমছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি ও আনোয়ার ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. দিল জাহান ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, চামড়াশিল্পে প্রথম বিপর্যয় আসে সাভারের চামড়া পল্লী প্রস্তুত না করে হাজারিবাগ থেকে স্থানান্তর করা। তখনই অপ্রস্তুত সাভারের চামড়া পল্লীতে বিদেশি ক্রেতারা গিয়ে হাট সমান ময়লা পানি দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমরা বড় বড় বাজার হারিয়েছি। তিনি বলেন, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া পণ্যের চাহিদা কমেছে। অন্য দিকে সিনথেটিক (বিকল্প চামড়া) দিকে ক্রেতারা ঝুঁকছে। এর কারণ হচ্ছে চামড়া পণ্যের, যে দাম তার অর্ধেকে সিনথেটিকের পণ্য পাওয়া যায়।

চামড়ার দাম কমলেও চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর আমাদের সময়কে বলেন, চামড়ার দাম কমলেও পণ্য প্রস্তুত করতে যেসব কেমিক্যালের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ ছাড়া শ্রমিকের বেতন, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহন খরচসহ আনুসঙ্গিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্য উৎপাদনে খরচ বেড়েছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button