জাতীয়

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ৪ দফা প্রস্তাব

রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে জাতিসংঘের চলতি ৭৪তম অধিবেশনে ৪ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে তিনি এই ঘোষণা দেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন এবং ওআইসি সেক্রেটারিয়েট যৌথভাবে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: যে প্রস্তাবগুলো আমি জাতিসংঘের চলতি ৭৪ তম অধিবেশনে উত্থাপন করবো সেগুলো হচ্ছে-

১. রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন বিষয়ে মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছে সুস্পষ্ট করতে হবে। এজন্য রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কী করছে সেটাও সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে।

২. বৈষম্যমূলক আইন ও চর্চা পরিত্যাগ করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন রাজ্যে ‘যাও এবং দেখ’ এই নীতিতে পরিদর্শনের অনুমতি দিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে।

৩. রাখাইন রাজ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েন করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই রোহিঙ্গাসহ সবার নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্য নিশ্চিত করতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতা দূর করা হয়েছে ।

এর আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনেও তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসরনে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সেই বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন: ওই প্রস্তাবে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ সমূহের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নসহ রাখাইন রাজ্যে একটি বেসামরিক নিরাপদ পর্যবেক্ষণ এলাকা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও ছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: রোহিঙ্গা সংকট একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এর মূল মিয়ানমারে গভীর প্রথিত। সুতরাং এ সংকটের সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই খুঁজে পেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এর স্থায়ী সমাধান বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

‘রোহিঙ্গাদের অবশ্যই তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে হবে, যেখানে তারা শতাব্দির পর শতাব্দি বসবাস করেছিল,’ বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: এটি অত্যন্ত দু:খজনক যে, রোহিঙ্গা সমস্যার কোনরকম সমাধান ছাড়াই আমরা আরও একটি বছর পার করে দিয়েছি। মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা নৃশংস অপরাধের শিকার হচ্ছে। টেকসই, নিরাপদ এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চলমান কার্যক্রম অনুসরণ করছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, ওআইসি তার জবাবদিহিতা সম্পর্কিত অ্যাডহক মন্ত্রিপরিষদ কমিটির মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা পূরণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

শেখ হাসিনা বলেন: জোরপূর্বক নির্বাসিত ১১ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা আমাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছিলাম, যা ইসলামের নৈতিক শিক্ষা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে এবং তাদের দেশে ফেরত না যাওয়া অবদি সম্ভব সকল ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা ৬ হাজার ৮শ’ একরের বেশি বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে, যাতে বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন: বাংলাদেশে আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্য সেবা, পানি, স্যানিটেশনসহ রোহিঙ্গাদের সব ধরনের মানবিক সহায়তা দিচ্ছি। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় সাধনে বিপুল সংখ্যক বেসরকারী খাতের জনবলকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: সড়ক-বিদ্যুৎ সরবরাহসহ নতুন ও অতিরিক্ত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে ২১৯টি মেডিক্যাল সুবিধা স্থাপন করা রয়েছে। যার মধ্যে ৫০টি সরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যক্ষ সহায়তার জন্য সরকারের কোষাগার থেকে প্রায় ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অধিক ঘনবসতির সমস্যা সমাধান এবং মানবিক সেবার সুবিধার্থে সুরক্ষার সমস্ত বিধান রেখে রোহিঙ্গাদের জন্য আমরা ভাসানচরের উন্নয়ন করেছি।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড.মাহাথির মোহাম্মদ, ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসেফ বিন আহমেদ আল-ওথাইমেন এবং সৗদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড.ইব্রাহিম বিন আব্দুলআজিজ আল-আসাফ ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ বলেন: মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনো ভালো কিছু নয়। অনেক রোহিঙ্গা ব্যক্তি রাখাইনের অভ্যন্তরীণ-বাস্তচ্যুত শিবিরে (আইডিপি) বাস করছে এবং দিনে দিনে তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। বিশ্ব যখন অতীতের কুখ্যাত বন্দী শিবিরগুলোর সঙ্গে আইডিপি ক্যাম্পগুলোর মিল খুঁজে পেল, তখন মিয়ানমার সরকার দ্রুত তা অস্বীকার করছে।

তিনি প্রশ্ন করেন: মিয়ানমারের কাছে গোপন করার মতো কিছু যদি না থাকে, তাহলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘর কর্মকর্তা এবং মানবিক সহায়তা কর্মীদের রাখাইনের পরিস্থিতি দেখতে যেতে বাধা দিচ্ছে কেন?

‘জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং মানবিক সহায়তা কর্মীদের পরিদর্শনের জন্য অবাধে সেখানে যাতায়াত করতে এবং শিবিরগুলোতে বাস করা মানুষদের সহায়তা করতে দিন। মিয়ানমারের উচিত সংকট সমাধানের অযোগ্য হয়ে ওঠার আগেই তা নিরসন করুন। প্রত্যাবাসন হওয়া উচিৎ প্রথম অগ্রাধিকার’, বলেন ড. মাহাথির মোহাম্মদ।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন: কিছু শরণার্থীকে প্রত্যবাসনের জন্য দুইবার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু দুইবারই ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি নিরাপদ স্বতন্ত্র ও মর্যাদাপূর্ণ অধিকার দিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিয়েই কেবলমাত্র এই সংকট নিরসন করতে হবে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ভয়, বিদ্বেষ ও সহিংসতা উস্কে দেয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের ইস্যুটিকে ব্যবহার করেছে।

তিনি বলেন: এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমার সরকার এই সঙ্কটের সমাধান করতে রাজি নয়। সুতরাং এটি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই পরিস্থিতি নিয়ে কিছু করতে হবে। সিকিউরিটি কাউন্সিলের পদক্ষেপ ছাড়া, সংকটের সমাধান এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে অন্যদের অবশ্যই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ড. মাহাথির বলেন: আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিবাচক প্রচেষ্টা গ্রহণের জন্য মালয়েশিয়া ওআইসির প্রশংসা করেছে। অপরাধীরা যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা থেকে যেন রেহাই না পায়, এটি নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের বিষয়টি আনার সিদ্ধান্তে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আশা করি, অন্যান্য দেশগুলো ওআইসিকে সমর্থন করবে।

‘আমরা আশা করি রোহিঙ্গাদেও এই দুর্দশা শেষ করতে অন্যান্য দেশও বাংলাদেশ ও আমাদের পাশে দাঁড়াবে। আমাদের এখনই এই সংকটের অবসান ঘটাতে হবে। আসুন, আমরা খোলাখুলিভাবে এই ব্যাপারে কথা বলি। রাখাইন রাজ্যে যা হয়েছে তা হচ্ছে গণহত্যা’, বলেন ড. মাহাথির।

তিনি বলেন: সেখানে গণহত্যা, ব্যাপক গণধর্ষণ ও অন্যান্য বড় ধরনের মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে।

এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী এবং প্রতিনিধিরা যোগ দেন। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানী, বেলজিয়াম, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন, নেদারল্যান্ড, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, সার্বিয়া, ফিলিপিন্স  এবং গাম্বিয়া থেকে আগত অতিথিরা রয়েছেন।

অনুষ্ঠানের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন: আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন চান।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন: সৌদি আরব আয়োজিত একটি অঙ্গীকার অধিবেশনের পর এটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ওআইসিভুক্ত বিভিন্ন দেশ ইউএনএইচসিআর-কে মোট ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button