ধর্ম

পবিত্র কুরআনের আলোকে আহলে বাইতের পরিচয় ও মর্যাদা

চাঁপাইনবাবগঞ্জঃ তিরমিজি শরীফে ই:ফা:(৩৭৮৬ নং হাদীসে) এসেছে, মহানবী স. পবিত্র বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের মাঝে দুটি মুল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি যা তোমরা অনুসরণ করলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; আর তা হলো আল্লাহর কিতাব কুরআন এবং আমার বংশধর আহলে বাইত।” মহানবীর এই বক্তব্য অনুযায়ী হেদায়েত পেতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে কুরআন মাজিদ এবং আহলে বাইতের অনুসরণ করতে হবে। কুরআন মাজিদের সাথে আমাদের মোটামুটি পরিচয় থাকলেও আহলে বাইত সম্পর্কে আমাদের মুসলিম সমাজ প্রায় উদাসীন। তাদের সঠিক পরিচয় এবং মর্যাদা সম্পর্কে অনেকের সঠিক ধারণা নেই। তাই আসুন আমরা পবিত্র কুরআনের আলোকে মহানবী স. এর পবিত্র আহলে বাইতের পরিচয় ও মর্যাদা জানার চেষ্টা করি।
১. আয়াতে তাত্বহীর:
আহলে বাইতের সঠিক পরিচয় জানতে হলে আমাদেরকে সুরা আহজাবের ৩৩ নং আয়াত যা আয়াতে তাত্বহীর নামে পরিচিত তা ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে নবীর আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক চান তোমাদের থেকে সকল অপবিত্রতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে।” এ আয়াতের আগে পরে নবীর স্ত্রীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে এজন্য অনেকে অত্র আয়াত বুঝতে গিয়ে ভুলের শিকার হয়েছেন এবং নবীর স্ত্রীদেরকে আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত বলে মত ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু কয়েকটি কারণে আয়াতের এ অংশটুকু নবীর স্ত্রীদের সাথে সম্পর্কিত নয়। আর সে বিষয়গুলি হলো;
প্রথমত: এই অংশের প্রথমে আল্লাহ তাআলা “ইন্নামা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যখন কোন বাক্যের প্রথমে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় তখন ঐ বাক্যটির সাথে পূর্বের আলোচনার বিছিন্নতা ঘটে, অর্থাৎ “ইন্নামা” শব্দের মাধ্যমে নতুন বক্তব্যের সূচনা হয়।
দ্বিতীয়ত: অত্র আয়াতের আগে ও পরে নবীর স্ত্রীদের জন্য স্ত্রীবাচক সর্বনাম “কুন্না” ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এই অংশে পুরুষবাচক সর্বনাম “কুম’ ব্যবহার করা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় অত্র বাক্যের দ্বারা নবীর স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করা হয়নি। তবে নবীর আহলে বাইতের মধ্যে হযরত ফাতেমা জাহরাও রয়েছেন, কিন্তু পুরুষ লোকদের আধিক্যের কারণে পুরুষবাচক সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
তৃতীয়ত: তিরমিজি শরীফে ই:ফা:(৩৭৮৭ নং হাদীসে) এসেছে, যখন হযরত উম্মে সালামার বাড়িতে মহানবী স. এর উপর আয়াতে তাত্বহীর নাজিল হলো তখন তিনি হযরত ফাতেমা, হযরত আলী, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে ডেকে তাদেরকে চাদর দ্বারা আবৃত করে বললেন, “হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বাইত, অতএব তুমি এদের থেকে সকল অপবিত্রতা দূরে রাখ এবং এদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র রাখ। ঐ সময় হযরত উম্মে সালামা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমিও কি তাদের সাথে আছি? তিনি বললেন, তুমি তোমার জায়গায় আছ এবং তুমি কল্যাণের উপর আছ।” অতএব এই হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় আয়াতে তাত্বহীরে উল্লেখিত আহলে বাইতের মধ্যে নবীর স্ত্রীরা অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং মহানবীর পক্ষ থেকে ঘোষিত ব্যক্তিরাই তাঁর আহলে বাইত।
২. আয়াতে মাওয়াদ্দাত:
আহলে বাইতের মর্যাদা এতই বেশী যে তাদেরকে ভালবাসা আমাদের সকলের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। সুরা শুরার ২৩ নং আয়াত যা আয়াতে মাওয়াদ্দাত নামে পরিচিত সেখানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “হে নবী! আপনি বলে দিন, আমি আমার নবুয়তী কাজের বিনিময়ে তোমাদের নিকট আমার নিকট আত্মীয়ের প্রতি ভালবাসা ছাড়া অন্য কোন পারিশ্রমিক চাই না।” তাফসীরে দুররুল মানসুরে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, যখন এই আয়াতটি নাজিল হলো তখন সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসুল! আপনার নিকটাত্মীয় কারা যাদেরকে ভালবাসা আমাদের উপর ফরজ করে দেয়া হয়েছে? তখন আল্লাহর রাসুল বললেন, “তারা হলেন হযরত আলী, হযরত ফাতেমা এবং তার দুই সন্তান ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন।” আহলে বাইতকে ভালবাসার ব্যাপারে মহান আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও আমরা দেখতে পাই মহানবীর ইন্তেকালের পর তার আহলে বাইতের উপর সবচেয়ে বেশী জুলুম করেছিল মুসলমান নামধারী মুনাফেকরা। তারা হযরত আলীকে কুফার মসজিদে ফজরের নামাজরত অবস্থায় শহীদ করেছে। তারা হযরত ফাতেমা জাহরাকে শহীদ করেছে। ইমাম হাসানকে তারাই বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করেছে। আর কারবালার ময়দানে তাদের মাধ্যমেই ইমাম হোসাইন আ. ৭২ জন সাথী নিয়ে ইসলামকে রক্ষার জন্য শাহাদাৎ বরণ করেছেন। এই হলো নবীর আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার নমুনা!
আল্লামা জামাখশারী তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ আল কাশশাফে অত্র আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে মহানবীর আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস বর্ণণা করেছেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদীসগুলিতে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী স. বলেন, “যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি  ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, সে শহীদ হিসাবে মারা গেলো। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি  ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলো। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, সে তওবাকৃত হিসাবে মারা গেলো। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি  ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, সে মুমিন হয়ে পূর্ণ ঈমান নিয়ে মারা গেলো। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, তাকে মৃত্যুর ফেরেশতা জান্নাতের সুসংবাদ দিবে এবং এরপর মুনকার ও নাকীরও সুসংবাদ দিবে। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, আল্লাহ তার কবরকে বানাবেন রহমতের ফেরেশতাদের জন্য  যিয়ারতের স্হান। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে মারা গেলো, তার জন্য কবরে জান্নাতের দিকে দুটো দরজা খুলে দেয়া হবে। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ঘৃণা নিয়ে মারা গেলো, সে কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে এমন অবস্থায় যে তার দুচোখের মাঝখানে লিখা থাকবে, “আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ।” জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ঘৃণা নিয়ে মারা গেলো, সে অবিশ্বাসী হয়ে মারা গেলো। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ স. এর পরিবারের প্রতি ঘৃণা রেখে মারা গেলো, সে কখনো জান্নাতের সুগন্ধ পাবে না।” অতএব আসুন মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতকে ভালবেসে ঈমানকে পরিপূর্ণ করি।
 লেখকঃ মাওলানা আবদুল্লাহ (পি.এইচ.ডি) গবেষক, আল মোস্তফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Back to top button