অর্থনীতি

ব্যাংকিং খাত সংস্কারে এডিবির রূপরেখা

খেলাপি ঋণ হ্রাসসহ ব্যাংকিং খাত সংস্কারে সরাসরি কাজ করবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। আন্তর্জাতিক এ সংস্থা তাদের কাজের আওতায় একটি এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি) গঠন করবে।

এছাড়া সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনসহ ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতের বিচারকদেরও খেলাপি বিষয়ে সচেতনা বৃদ্ধি কর্মসূচি নেয়া হবে। এডিবি কাঠামোগত সংস্কার, আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী এডিবির এ প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সূত্রমতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা কাটাতে সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের নিজস্ব টুলস ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে আরও উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

এডিবির সহায়তা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত সংস্কার হিসেবে এডিবি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর আগে এডিবি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে একটি সমীক্ষা করবে। এরপর তারা আর্থিক ও টেকনোলজি সব ধরনের সহায়তা করবে।

জানা গেছে, সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয় অর্থমন্ত্রীর কাছে। সেখানে বিশ্বের যেসব দেশে এডিবি ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমানো নিয়ে কাজ করেছে, সেসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম।

সারসংক্ষেপে তিনি বলেছেন, খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে বিভিন্ন দেশে গঠিত এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম রয়েছে। এই ফোরামের নাম ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ফোরাম (আইপিএফ)।

২৫ সেপ্টেম্বর এই আইপিএফের আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়। ওই কনফারেন্সে কম্বোডিয়া ও জাম্বিয়া পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে।

এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করেন।

ব্যাংকিং সচিব আরও বলেন, ২০১২ সালে এডিবির সহায়তা আইপিএফ গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কাজাখস্তানে মোট ১৩টি পাবলিক ও প্রাইভেট এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এরা প্রত্যেকে আইপিএফের সদস্য।

সূত্রমতে, এডিবি দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন ও ভিয়েতনামে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে কাজ করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় খেলাপি ঋণ কমাতে কেএএমসিকো নামে একটি এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করেছে এডিবি।

১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কমাতে বিশেষ আইনের ক্ষমতাবলে কেএএমসিকো নামে এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে এডিবি। ওই সময় দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

কেএএমসিকো কার্যক্রমের ফলে ২০১৯ সালে দেশটিতে খেলাপি ঋণ কমে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে। একইভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি খেলাপি ঋণ কমাতে ২০১৩ সালে ভিয়েতনামে নির্বাহী আদেশে ভিএএমসি নামে এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে।

১৭ শতাংশ খেলাপি ঋণের হার নিয়ে আইবিআরএ কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালের হিসাবে ভিয়েতনামে খেলাপি ঋণের হার কমে ৩ শতাংশে এসেছে। পাশাপাশি ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় এডিবি গঠন করেছে ডানাহারলজ নামে এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি।

ওই দেশের ১৯৬৫ সালের কোম্পানি আইনে এটি গঠন করা হয়। ওই সময় মালয়েশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১ শতাংশ। ডানাহারলজ কাজ শুরুর পর ২০১৯ সালের আগস্টে তা ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে।

সূত্র আরও জানায়, ২০০১ সালে স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী আদেশ ২০০০ এর ক্ষমতাবলে এডিবি এফআরএফ নামে চীনে এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে। ওই সময় চীনে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৫ শতাংশ।

এফআরএফ কাজ শুরুর পর ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের হার কমে ১ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে। এছাড়া থাইল্যান্ডে একইভাবে টিএএমএল নামে একটি এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হয়।

এডিবির সহায়তায় ২০০১ সালে ইমার্জেন্সি ডিগ্রির ক্ষমতাবলে এটি গঠন করা হয়েছিল। ওই সময় দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ। টিএএমএল কাজ শুরু পর খেলাপি ঋণের হার কমে ৩ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকায়। আর অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

আগের বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে এক নম্বর সমস্যা। এক্ষেত্রে এডিবি কাজ করলে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব। কারণ সংস্থাটি নিজস্ব টুলস ব্যবহার করে এরই মধ্যে অন্যান্য দেশের খেলাপি ঋণ কমিয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন সংশোধন করে সঠিকভাবে আইন বাস্তবায়ন করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমে আসবে। এজন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছা।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button