অর্থনীতি

স্বর্ণের বাজার অস্থির: দুই মাসে ভরিতে বেড়েছে ৮ হাজার

স্বর্ণের বাজারে অস্থিরতা চলছে। গত দুই মাসে সোনার দাম ভরিতে বেড়েছে ৮ হাজার টাকা। বর্তমানে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা ৫৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশেও দাম বাড়াতে হয়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে।

তবে বৃহস্পতিবারও সোনার আন্তর্জাতিক বাজারের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ দুবাইয়ে প্রতি গ্রাম সোনার দাম ছিল ৪৮ ডলার। এ হিসাবে প্রতি ভরির দাম পড়ে ৪৮ হাজার টাকা।

বাংলাদেশের সঙ্গে ওই বাজারের ভরিতে পার্থক্য ১০ হাজার টাকারও বেশি। তবে দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বাজারে স্বর্ণের বিক্রি অনেক কমে গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সভাপতি ভেনাস জুয়েলার্সের মালিক গঙ্গাচরন মালাকার বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতসহ বড় দেশগুলোর অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব পড়েছে সোনার দামে।

এসব দেশ তাদের মুদ্রার মানও কমিয়েছে। কমেছে ঋণের সুদের হারও। ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে। স্বর্ণের এই বাড়তি চাহিদার কারণে প্রভাব পড়ছে দামে।তবে ভরিতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ১০ হাজার টাকা পার্থক্য মানতে চাচ্ছেন না তিনি।

তিনি বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ববাজারের পার্থক্য ২ হাজার টাকার বেশি নয়।বর্তমানে বিদেশ থেকে কেউ এলে ব্যাগেজ রোলে ২শ’ গ্রাম (১৭ ভরি) পর্যন্ত স্বর্ণ নিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে ৩ হাজার করে শুল্ক দিতে হয়। তবে শুল্ক ছাড়াই ১০০ গ্রাম পর্যন্ত গহনা নিয়ে আসা যায়।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে ক্যারেটের প্রকারভেদে দেশে ৪ ধরনের সোনা বিক্রি হয়। এর মধ্যে ২২ ক্যারেটের (৯২ শতাংশ খাঁটি) সোনা বেশি বিক্রি হয়। বৃহস্পতিবার দেশে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৫৮ হাজার ২৬ টাকা। ৫ শতাংশ ভ্যাটসহ মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬১ হাজার টাকা।

এছাড়াও সব ধরনের স্বর্ণের ভরিতে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি হিসাব করলে প্রতি ভরির দাম পড়ে ৬৪ হাজার টাকা। তবে ক্রেতা কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ভ্যাট ছাড়াই স্বর্ণ বিক্রি করছে। তবে অনেক ব্যবাসায়ী ভ্যাট আদায় করলেও তা আবার ঠিকমতো পরিশোধ করছে না।

অনেক প্রতিষ্ঠানে ইসিআর থাকলেও সেটি ব্যবহার না করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভ্যাট পরিশোধ করছে না। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি গ্রাম ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল ৪৮ ডলার। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় প্রতি ভরির দাম পড়ে প্রায় ৪৮ হাজার টাকা।

ওইদিন স্বর্ণের আরেকটি বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ছিল ৪৯ ডলার। সাধারণত, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা থাকলেই স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়ে। এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে মুদ্রার মান কমিয়েছে চীন।

এছাড়া ডলারের বিপরীতে ভারতও রুপির দাম কমিয়েছে। ফলে মানুষ স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে। আগামীতে তা আরও বাড়তে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ভরিতে সোনার দাম আরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতিবছর দেশে সোনার চাহিদা প্রায় ২১ টন। কিন্তু বৈধভাবে গত ১০ বছরে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। অর্থাৎ সোনার ব্যবসার প্রায় পুরোটাই অবৈধ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথম হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থ পাচার হচ্ছে।

অপরদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। জুয়েলারি সমিতির নেতারা বলছেন, স্বর্ণে শুল্ক অত্যন্ত বেশি। এ কারণে আমদানি হয় না। তবে তাদের দাবি, বিদেশ থেকে বাংলাদেশিরা যে সব স্বর্ণ নিয়ে আসছে সেগুলোই তারা কিনছেন। কিন্তু এই হার মোট চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম।

সূত্র বলছে, প্রতি বছর বিভিন্ন সংস্থা যে পরিমাণ সোনা আটক করছে, অবৈধপথে তার ১০ গুণের বেশি সোনা ঢুকছে দেশে। এর একটি অংশ বাংলাদেশে থাকছে। বাকি সোনা বিভিন্ন পথে পাচার হচ্ছে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে।

সূত্রমতে, দেশে অবৈধ পথে আসা সোনার যৎসামান্য দেশে থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সোনা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোনা পাচার হচ্ছে ভারতে। অভিযোগ রয়েছে- সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ কাস্টমস, শুল্ক ও গোয়েন্দা, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে সোনা পাচারের ঘটনা ঘটছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দুটি বিষয় খুবই উদ্বেগের। প্রথমত, তথ্য-উপাত্তে মনে হচ্ছে, দেশের চাহিদার বড় অংশই চোরাই পথে আসার মাধ্যমে পূরণ হয়। দ্বিতীয়ত দীর্ঘদিন থেকে ভারতের স্বর্ণ পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দর।

তিনি বলেন, বৈধভাবে স্বর্ণ না আসায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়াও বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ কারণে স্বর্ণের নীতিমালার ওপর জোর দিয়েছেন মির্জ্জা আজিজুল।

এ ব্যাপারে গঙ্গাচরন মালাকার বলেন, স্বর্ণের বাজারে আজকের যে বিশৃঙ্খলা, সে জন্য সরকার দায়ী। কারণ দেশে স্বর্ণের কোনো নীতিমালা নেই। বাজুসের পক্ষ থেকে গত ২৫ বছর ধরা বলা হচ্ছে, অথচ নীতিমালার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

তিনি বলেন, আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক অত্যন্ত বেশি। এ কারণে মানুষ ভিন্ন চিন্তা করছে। তিনি বলেন, বর্তমানে কোনো অবৈধ সোনা নেই। কর দিয়ে সব বৈধ করা হয়েছে। এছাড়াও একটি নীতিমালার কাজ চলছে।

জুয়েলারি সমিতি বলছে, অব্যাহত লোকসানের মুখে ২০ ভাগ ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে সোনার মতো বিলাসী পণ্য কিনতে পারছে না। বাড়তি দামের কারণে ক্রেতারা সিটি গোল্ডের দিকে ঝুঁকছেন।

এছাড়া গোল্ড প্লেটেড নামে এক ধরনের পণ্য রয়েছে। রুপার ওপর স্কর্ণের প্রলেপ দিয়ে বিক্রি হচ্ছে। ফলে মধ্যবিত্তরা সেদিকেই ঝুঁকছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button