অর্থনীতি

৬ বছরে বেসরকারি খাতে সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের তহবিল সংকট ও সরকারের ঋণ বাড়ার ফলে তারা পর্যাপ্ত ঋণ বিতরণ করতে পারছেন না। ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বর্তমানে ব্যাংক থেকে তাদের চাহিদামতোও ঋণ নিতে পারছেন না। এমতাবস্থায় গত ৬ বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

চাহিদা অনুযায়ী বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার এমন চিত্র ফুটে উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনেও। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। যা কি না ২০১৩ সালের জুনের পর সর্বনিম্ন অনুপাত। এ সময় ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে।

এ দিকে, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাগণ বলছেন, ২০১৩ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। তবুও সে সময়ের চেয়েও বর্তমানে খারাপ সময় অতিবাহিত করছে বেসরকারি ব্যাংক খাত। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ায় অনেকেই পারছেন না তাদের ব্যবসা বাড়াতে। বাড়ছে না কর্মসংস্থানও।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ের শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১০ লাখ দুই হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। একই সময়ে গত বছরের যার পরিমাণ ছিল নয় লাখ এক হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে এক লাখ এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এ দিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি হিসাব অনুযায়ী, গত জুনের তুলনায় জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণ বাড়েনি বরং কমেছে। জুনে ঋণের স্থিতি ছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ২৫৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যেখানে এক মাসের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ কমেছে সাত হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।

তরুণ উদ্যোক্তা কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক কাজী সাজিদুর রহমান জানান, ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোতে গেলেই সেখান থেকে বলা হয়, ব্যাংকে টাকা নেই। ব্যবসা বড় করতে হলে অবশ্যই ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছি না। তার মতোই অন্যান্য উদ্যোক্তারাও একইভাবে তাদের চাহিদামতো ঋণ পাচ্ছেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

উদ্যোক্তা কাজী সাজিদুর রহমান বলেন, তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের কাছে ২০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছেন। কিন্তু মাত্র পাঁচ কোটি টাকাও তিনি পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে, সেখানে বলা হয় গত দুই বছর যাবত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। যত দিন যাচ্ছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ততই কমে আসছে।

এ দিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারির থেকে এ বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে এ অনুপাত কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। পরের মাস মার্চে এটি আরও কমে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশে নেমে যায়। এভাবেই এপ্রিলে কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে এবং সর্বশেষ জুলাইয়ে আরও কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ছিল। ফলে ২০১৮ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আনতে এডিআর কিছুটা কমিয়ে আনে। এরপর থেকেই ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। বেশ কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও বাড়ছে না ঋণের প্রবৃদ্ধি। ঋণ প্রবৃদ্ধির এ নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।

এ দিকে, চলমান অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।

অপরদিকে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে আমানত কিছুটা বাড়লেও এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় আমানত পাচ্ছেন না তারা। এর ফলে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের ঋণের চাহিদা মেটাতে পারছেন না। এছাড়া ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) নতুন সীমায় নামিয়ে আনার চাপও রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান জানান, উচ্চ সুদের হারের কারণেও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। কারণ, উচ্চ সুদে অনেকেই ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে, ব্যাংকের তহবিল সংকট ও সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়াকেই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন তারা।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button