জাতীয়

ধান-চালের বাজারে কালো টাকা

এবারের বোরো মৌসুমে দেশে ২ কোটি ৭ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১১ লাখ টন বেশি। বোরোর এত ভালো উৎপাদন বিগত ২০ বছরেও হয়নি। অথচ এ বছরই চালের দাম এত অস্বাভাবিক বেড়েছে যা দেশের ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, বাম্পার ফলনের পরও কেন চালের আকাশছোঁয়া দাম। সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল সময়ের আলোর পক্ষ থেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধান-চালের বাজারে কালো টাকা ঢুকেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছু লোকের হাতে প্রচুর টাকা রয়েছে, করোনাকালীন সময়ে বিনিয়োগের ভালো কোনো জায়গা না পাওয়ায় তারা ধান-চালের বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এরা হয়ে গেছেন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধান-চাল ব্যবসায়ী, এদের হাতেই চলে গেছে ধানের মজুদ। মূলত এ কারণেই বোরোর ভরা মৌসুমেও সারা দেশে ধানের জন্য হাহাকার আর চালের বাজার বেসামাল। সরকার লাখ লাখ টন চাল আমদানি করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না চালের দাম।
এর সত্যতা স্বীকার করেছেন খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খাতুন। সময়ের আলোকে তিনি এ বিষয়ে বলেন, অনেক নতুন লোক ধান-চালের ব্যবসায় নেমেছে। তারা টাকা বিনিয়োগের আর কোনো জায়গা হয়তো খুঁজে পায়নি করোনাকালে। তবে কেউ কালো টাকা দিয়ে ধান-চাল কিনে মজুদ করেছে কি না সেটি আমি বলতে পারব না। তা ছাড়া সাদা টাকাও বিনিয়োগ হতে পারে। এ ছাড়া করোনাকালে অনেক ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা হয়তো টাকা জোগার করে ধান-চালের ব্যবসায় নেমেছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা কী করছে, কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করে রাখছে, হয়তো লাভ পেলে ছেড়ে দিচ্ছে। এভাবে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের হাতে অনেক ধান চলে গেছে। এতে বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে, ফলে ধানের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে চালের বাজারে, বাড়ছে চালের দাম।
তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি কোথাও ধান-চালের অবৈধ কোনো মজুদ আছে কি না সেটি দেখতে। সরকারের অনুমোদিত পরিমাণে মজুদ যদি কারও কাছে থাকে তা হলে তো কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু কেউ যদি ধান-চালের অবৈধ মজুদ করে রাখে তাকে তো কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তবে কৃষক পর্যায়ে বা মৌসুমি ব্যবসায়ী পর্যায়ে যদি মজুদ থাকে সে ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। কারণ তারা তো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মিলমালিক বা অনুমোদিত ব্যবসায়ীরা বাড়তি মজুদ রাখলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এসব কারণে বোরোর বাম্পার ফলন হলেও এর সুফলটা পাওয়া যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখন ২০ হাজার হাস্কিং ও অটো রাইস মিল রয়েছে। সারা বছর কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে এই মিলমালিকরাই মাড়াই করে চাল বাজারে সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু এবারের বোরো মৌসুমে মিলমালিকরা ধান কিনতে গিয়ে ধান পাচ্ছে না। ধান না পাওয়া কারণ বাজারে ধানের সরবরাহ কম। অধিকাংশ ধান চলে গেছে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের কবলে। যেসব এলাকায় বেশি চাল কল রয়েছে সেসব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের বোরো মৌসুমের একেবারে শুরু থেকেই কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী মাঠে নেমেছিলেন। এ ধরনের ব্যবসায়ীর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে মূলত গত বছর থেকে। এই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভরা মৌসুমে কম দামে কিনে মজুদ করে রেখে অফ সিজনে চড়া দামে বিক্রি করছে। একেকজন ৫০-৬০ গাড়ি ধান মজুদ করে রাখছে। এদের অধিকাংশই অবৈধ টাকার মালিক।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সময়ের আলোকে বলেছেন বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, এবার এত বাম্পার ফলন হওয়ার পরও ভরা সিজনে যখন ধানের সঙ্কট হয় তা হলে এটি কিসের আলামত। আমি মনে করি এটা কালো টাকার প্রভাব। মানুষের হাতে প্রচুর কালো টাকা আছে, করোনাকালে বিনিয়োগের জায়গা না পেয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে ধানের বাজারে। আবার এমনও আছে, এলাকার বড় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, তার প্রচুর টাকা আছে, কিন্তু তিনি সরাসরি ধান না কিনে লাভের ওপর কোটি কোটি টাকা বাজারে ছেড়ে রেখেছেন। ঘরে বসে থেকে তিনি কমিশন পেয়ে যাচ্ছেন। এভাবে কোটি কোটি টাকা নিয়ে তারা হাজার হাজার মণ ধান কিনে মজুদ করে রেখেছে। মিলমালিকরা কিন্তু কোটি কোটি টাকা লোন পায়নি ব্যাংক থেকে যে তারা ধান কিনে মজুদ করে রাখবে। মিলমালিকরা যদি ধান না কেনে তা হলে কারা কিনল, কিনেছে ওই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীরা। তা হলে এত ধান কোথায় গেল। গায়েব হয়ে গেল নাকি। পরিস্থিতি এখন এমন যেন বাজারে চালের চাহিদার অর্ধেকই ঘাটতি, আসলে ঘাটতি তো নেই। ধান আছে, কিন্তু সেটি অন্যত্র মজুদ অবস্থায়। ধান নেই, চাল নেই এ কথা সত্যি না। সবই আছে কিন্তু সেগুলো মিলমালিকদের কাছে না অন্য ব্যবসায়ীদের হাতে। মিলমালিকদের কাছে ধান থাকলে তিনি মিল বন্ধ করে রাখতে পারতেন না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার বোরো উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫০৮ টন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোর তুলনায় ফলনের পরিমাণও বেড়েছে। গত বছর দেশে বোরো ধানের জাতীয় গড় ফলন ছিল প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ৯৭ টন। এ বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৯ টনে। অর্থাৎ হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে দশমিক ৩২ টন, যা গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক শূন্য শতাংশ বেশি। এ বছর বোরোর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১১ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। এবার বোরোতে ২ কোটি ৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সব মিলিয়ে এ উৎপাদন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এখনও বোরো মৌসুম চলছে, কিন্তু চালের দাম বেড়েই চলেছে। সরকার চাল আমদানি আবারও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। নতুন করে এ সপ্তাহে মোট ৩০১ প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর আগেও ৩ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। ১০ লাখ টনেরও বেশি চাল আমদানি করা হয়েছিল। তাতেও চালের বাজারে দাম কমেনি, উল্টো বেড়েই চলেছে। গতকাল রাজধানীর চালের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে ভালো মানের মিনিকেট চালের কেজি ৭০-৭২ টাকা। মাঝারি মানের মিনিকেট ৬৫-৬৮ টাকা, নাজিরশাইল চালের কেজি ৭২-৭৪ টাকা, বি-আর ২৮ চালের কেজি ৫৮ টাকা, মোটা চালের কেজি ৫২-৫৪ টাকা।
চালের বাজারে এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন এ বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, চালের এত দাম বৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। বাম্পার ফলনের পরও যখন দেশে এত চালের দাম বেড়েছে তা হলে বুঝতে পারছি সাপ্লাই চেইনে কোনো ঝামেলা আছে। যদি ধান-চালের বাজারে মৌসুমি ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম বেড়ে থাকে এবং তাদের কারণেই যদি বাজার অস্থিতিশীল হয়, তা হলে সরকারের উচিত কারা মজুদ করছে তাদের খুঁজে বের করা। কারণ করোনাকালে চালের অস্বাভাবিক মূূল্যবৃদ্ধি দেশের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ : অনেক কিছুই জানি কিন্তু কিছু বলতে পারছি না
বোরোর ভরা মৌসুমেও চালের দাম এতটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণ সম্পর্কে সময়ের আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেছেন, ধানের এত বাম্পার ফলন হওয়ার পরও চালের দাম বৃদ্ধির কারণ কীÑ এটা যেমন সাংবাদিকদের প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, তেমনি আমাদেরও প্রশ্ন। সাধারণত নতুন ধান উঠলে কৃষকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকরা ধান কিনে থাকেন। কিন্তু এখন কত রকমের যে ব্যবসায়ী গজিয়ে উঠেছে তার কোনো হিসাব নেই। এসব হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীর কব্জায় চলে গেছে অধিকাংশ ধান। শুধু মিল মালিকরা ধান কিনলে ধান-চালের বাজারে এই অস্থির অবস্থা হতো না।
তিনি বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ভরা মৌসুমে কম দামে কিনে মজুদ করে রেখে তারা অফ সিজনে চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। একেক জন ৫০ গাড়ি, ৬০ গাড়ি পর্যন্ত ধান মজুদ করে রাখছে। এদের অধিকাংশই অবৈধ টাকার মালিক। অর্থাৎ কালো টাকার বিনিয়োগ ঢুকেছে ধান-চালের বাজারে। এদের হাতেই চলে গেছে ধানের মজুদ। গত ২০ বছরেও আমরা এ রকম পরিস্থিতি দেখিনি, এবার যেভাবে বোরোর ভরা মৌসুমে ধানের সংকট হয়েছে।
আব্দুর রশিদ বলেন, সব সময় বলা হয় চালের বাজারে মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে। ২০ হাজারের অধিক মিল মালিক রয়েছেন। এত ব্যবসায়ী মিলে সিন্ডিকেট করতে পারে না। মিল মালিকরা কেজিপ্রতি চার আনা, আট আনা লাভে চাল বিক্রি করে থাকে। গত কয়েক বছরে চাল কলের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি বাড়েনি। অথচ ধানের বাজারে নতুন ব্যবসায়ীর সংখ্যা যে কত বেড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। এবার এত বাম্পার ফলন হওয়ার পরও ভরা সিজনে যখন ধানের সংকট হয় তাহলে এটি কিসের আলামত। আমি মনে করি এটা কালো টাকার প্রভাব। আবার এমনও আছে, এলাকার বড় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, তার প্রচুর টাকা আছে; কিন্তু তিনি সরাসরি ধান না কিনে লাভের ওপর কোটি কোটি টাকা বাজারে ছেড়ে রেখেছেন। ঘরে বসে থেকে তিনি কমিশন পেয়ে যাচ্ছেন। এভাবে কোটি কোটি টাকা নিয়ে তারা হাজার হাজার মণ ধান কিনে মজুদ করে রেখেছে। মিল মালিকরা কিন্তু কোটি কোটি টাকা লোন পায়নি ব্যাংক থেকে যে তারা ধান কিনে মজুদ করে রাখবে।
পরিস্থিতি এখন এমন যেন বাজারে চালের চাহিদার অর্ধেকই ঘাটতি, আসলে ঘাটতি তো নেই। ধান আছে, কিন্তু সেটি অন্যত্র মজুদ অবস্থায়। ধান নেই, চাল নেই এ কথা সত্যি নয়। সবই আছে কিন্তু সেগুলো মিল মালিকদের কাছে নয়, অন্য ব্যবসায়ীদের হাতে।
তিনি বলেন, মিল মালিকদের ধান মজুদ করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী মিল মালিকদের ১৫ দিনের বেশি ধান মিলে মজুদ করে রাখার সুযোগ নেই। রাখলেই জরিমানার মুখে পড়তে হবে। একটি মিল যদি প্রতি দিন ৫০০ টন ধান মাড়াই সক্ষমতার হয়, তাহলে ১৫ দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজার টন ধান মজুদ করতে পারবে একটি মিল মালিক। এর বেশি ধান মজুদ করার সুযোগ নেই। তবে এখানেও কথা আছে, ২০ হাজার মিল মালিক রয়েছে সারা দেশে। এর মধ্যে গুটিকয়েক মিল মালিক বাড়তি মজুদ করে না, সেটিও আমি বলব না। দুয়েকজন করতে পারে, তার মানে এই নয় যে, সব মিল মালিক মিলে চালের বাজারে সিন্ডিকেট করছে। মিল মালিকরা কখনই সিন্ডিকেট করে না চালের বাজারে।
মিল মালিকরা ধান মাড়াইয়ের জন্য ধান পাচ্ছে না, তাহলে ধান গেল কোথায়। সরকারের সংস্থাগুলোর খুঁজে বের করা দরকার, ধান কোথায় আছে। মিল মালিকরা সব সময় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সরকার চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো মিলে গিয়ে মজুদ পরিস্থিতি দেখতে পারে; কিন্তু গোটা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যারা ধান মজুদ করে রেখেছে তাদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। এদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে না বলেই চালের বাজারও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা অনেক কিছু জানি, কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। অবৈধ টাকার মালিকরাই ধান কিনে জিম্মি করে নিয়েছে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button