জাতীয়

সরকার গঠন করছে তালেবান, উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ

সরকার গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আফগানিস্তানের নতুন অর্থমন্ত্রী, অন্তর্বর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগ দিয়েছে তালেবান। এ ছাড়া কাবুলের গভর্নর ও মেয়রও নিয়োগ দিয়েছে ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী। আফগানদের কাবুল বিমানবন্দরে গিয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা না করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বিদেশিদের সরিয়ে নিতে হবে। পেন্টাগনে ইউএস অ্যাডমিরাল জন কিবরিও জানিয়েছেন, সময়সীমা বাড়ানো হবে না। এদিকে সিআইএর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন সম্ভাব্য পরবর্তী শাসক মোল্লা বারাদার। সঙ্কট উত্তোরণে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান মধ্যস্থতার আগ্রহ জানান দিয়েছে। তবে তালেবানের শাসনে নারীদের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বেসামরিকদের হত্যা, নারীদের চাকরি, পড়াশোনা ও চলাফেরার পাশাপাশি তালেবানি শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে বিধিনিষেধ আরোপসহ আফগানিস্তানে কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীটির করা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকার কর্মকর্তা মিশেল ব্যাশেলেট। ওদিকে পঞ্জশিরে দ্য ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ) এখনও তাদের  প্রতিরোধ জারি রেখেছে। সব জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে একটি সমন্বিত সরকার গড়ে তোলার দাবি না মেনে তালেবান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করলে পাল্টা প্রতিরোধের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বহুজাতিক আফগানিস্তানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বিত সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলাটা সহজ হবে না তালেবানের জন্য।
মন্ত্রী, মেয়র, গভর্নর ও গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগ
আফগানিস্তানের বার্তা সংস্থা পাজহোকের বরাত দিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, দেশটির নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে গুল আগা, অন্তর্বর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সদর ইব্রাহিম এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নাজিবুল্লাহকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোল্লা সেরিন আকন্দ রাজধানী কাবুলের গভর্নর এবং হামদুল্লাহ নোমানি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
এর আগে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে তালেবান। সংগঠনের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ পাকিস্তানভিত্তিক আফগান ইসলামিক প্রেসকে (এআইপি) জানিয়েছেন, দ্য আফগানিস্তান ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিসকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পর দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯৫০ কোটি ডলারের সম্পদ জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এক ঘোষণায় জানান যে, শিগগিরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হবে।
মার্কিন প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, মার্কিন রাজস্ব দফতরের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় এখনও নাম রয়েছে তালেবানের। এ কারণে তারা আফগানিস্তানে সরকার গঠন করলেও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো সম্পদ বা সম্পত্তির নাগাল পাবে না।
কাবুলে বারাদারের সঙ্গে সিআইএ’র পরিচালকের গোপন বৈঠক
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সশস্ত্র ইসলামী গোষ্ঠী তালেবানের নেতা ও সম্ভাব্য পরবর্তী শাসক আব্দুল গনি বারাদারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্রধানের গোপন বৈঠক হয়েছে। সোমবার কাবুলে তালেবানের এই নেতার সঙ্গে সিআইএ’র পরিচালক উইলিয়াম জে. বার্নসের ওই গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে যাওয়ার পর মার্কিন প্রশাসন এবং এই গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। তবে তাদের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানাতে অস্বীকার করেছে সিআইএ।
দেশ ছাড়তে মানা আফগানদের, বিদেশিরাও ফিরবে সময়সীমার মধ্যেই
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ আফগানদের দেশ ছাড়তে কাবুল বিমানবন্দরে ভিড় না করার আহ্বান জানান। তিনি অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশের সব বিশেষজ্ঞ লোকজনকে নিয়ে যাচ্ছে। ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে এটি বন্ধ করতে বলেছি’, বলেছেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানায় তালেবান। এর আগে সোমবার তালেবান হুঁশিয়ার করে, আফগানিস্তান থেকে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ না হলে পরিণতি ভোগ করতে হবে। কাবুল থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার সময়সীমা বৃদ্ধি নিয়ে প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমা বিশে^র নেতারা। তবে মার্কিন নাগরিক এবং আফগান মিত্রদের সরিয়ে নেওয়ার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তালেবান মুখপাত্র। পেন্টাগনের পক্ষ থেকেও সময়সীমা না বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে।
সঙ্কট উত্তরণে মধ্যস্থতায় আগ্রহী রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ জানিয়েছেন, তার দেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান আফগান সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্থতা করতে চায়।
নারী ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জাতিসংঘের
মানবাধিকার কাউন্সিলে দেওয়া এক বক্তৃতায় জাতিসংঘের শীর্ষ মানবাধিকার কর্মকর্তা মিশেল ব্যাশেলেট তালেবানের হাতে বেসামরিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত কিছু না বললেও কট্টর শরিয়া আইনের সমর্থক গোষ্ঠীটির কার্যক্রম নিবিড় পর্যবেক্ষণে একটি ব্যবস্থা দাঁড় করাতে আহ্বান জানিয়েছেন। ‘আগের তালেবানি শাসনে যে ধরনের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হওয়া হত্যাকাণ্ড ও টার্গেট করে হামলার যেসব প্রতিবেদন এসেছে তাতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও সহিংসতা এবং নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে,’ পাকিস্তান ও অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) অনুরোধ হওয়া মানবাধিকার কাউন্সিলের জরুরি অধিবেশনে বলেন ব্যাশেলেট।
পঞ্জশিরের প্রতিরোধ অব্যাহত
আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পঞ্জশিরকে তালেবানের হাত থেকে রক্ষা করতে সেখানে ব্যাপক প্রতিরোধ তৈরি করেছে দ্য ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ)। মিলিশিয়া যোদ্ধা এবং প্রাক্তন সরকারি সেনারা মিলে এনআরএফ তাদের ঘাঁটি পঞ্জশির উপত্যকায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বালির ব্যাগ দিয়ে সুরক্ষা তৈরির পাশাপাশি মেশিনগান, মর্টার ও নজরদারি পোস্ট বসিয়েছে তারা।
‘তালেবানের লক্ষ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি চায়, আবার তারা তাদের নিজস্ব ধারার ইসলামী শাসনব্যবস্থা চায়। তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন; এমন একজন বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে বলেছেন, তারা এই দুটি লক্ষ্য একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে না। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ছাড়া আফগানিস্তান শাসনও করতে পারবে না।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা
যুক্তরাজ্যের ল্যাংকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক অমলেন্দু মিশ্র কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটে লেখা এক নিবন্ধে বলছেন, ‘বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি পঞ্জশির উপত্যকা সরাসরি তালেবানকে সামরিকভাবে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়, জটিল অঞ্চল ও জাতিগত সংমিশ্রণের আফগানিস্তানে পরবর্তী সময়ে তা একীভূত সরকার চাপিয়ে দেওয়ার বাস্তবতাকে গুরুতরভাবে জটিল করে তুলতে পারে। মনে রাখা জরুরি, পঞ্জশির উপত্যকাসহ পশ্চিম ও উত্তর আফগানিস্তানের ফার্সিভাষী তাজিকরা অব্যাহতভাবে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের পুশতুনদের বিরোধিতা করে আসছে; যে পুশতুনেরাই তালেবানের মূল অংশ। একটি মুক্ত এবং যুদ্ধরত পঞ্জশির অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিমান, মিলিশিয়া নেতা এবং যুদ্ধবাজদের, যাকে এখন তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত করেছে, প্রতিরোধের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে।
ইতিহাসের দোহাই টেনে অধ্যাপক মিশ্র আরও বলছেন, আফগানরা খুব কম সময়ই একটি কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষের অধীনে একীভূত থাকে। রাষ্ট্রের জন্য চিরস্থায়ী অস্তিত্বের হুমকি সত্ত্বেও অতীতে, দেশের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী কখনও একটি জাতীয় ঐকমত্যের ধারণার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেনি। আশরাফ গনির সরকারের পতনের নেপথ্যেও ভূমিকা রেখেছে এই বাস্তবতা। তালেবানও সেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বিত সরকার গড়া তাদের জন্য সহজ হবে না। এই হিসাবই তালেবানবিরোধীদের চূড়ান্ত অস্ত্র হতে পারে।

আরো দেখুন

সম্পর্কিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button