খেলোয়াড়দের কিছু দাবিকে তো দাবি বলেই স্বীকার করেননি নাজমুল হাসান পাপন। কয়েকটা দাবিকে প্রচণ্ড অবহেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন। চলুন আরেকবার দেখা যাক খেলোয়াড়দের দাবিগুলোর বিষয়ে বিসিবির অবস্থান এবং বাস্তব অবস্থা, সঙ্গে সে সব বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ও শঙ্কা।
দাবি ১ : প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। খেলোয়াড়দের সংগঠন কোয়াবের কমিটিকে পদত্যাগ করতে হবে।
বিসিবির অবস্থান : কোয়াব নিয়ে এমন সমস্যা হবে জানলে তারা সংগঠনটিকে স্বীকৃতি দিত না। এটা তাদের সমস্যা না।
কোয়াবের অবস্থান : খেলোয়াড়দের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তারা। তারা পদত্যাগ করবে না।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : কোয়াব নিয়ে খেলোয়াড়রা কখনো তেমন চিন্তিত ছিল না। কোনো অবস্থায় নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজনরা যে কোয়াবের দায়িত্ব ছাড়তে তৈরি না তাও তাদের কথায় স্পষ্ট। খেলোয়াড়দের রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ার শঙ্কা অনেক বেশি।
দাবি ২ : ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলোয়াড়দের ক্লাব বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। প্লেয়ার বাই চয়েজ আর চান না খেলোয়াড়রা।
বিসিবির অবস্থান : পাপন বলেছেন, তিনি কিছুদিন আগে সিসিডিএম প্রধানকে বলে দিয়েছেন তাই হবে আগামী মৌসুম থেকে।
বাস্তবতা এবং শঙ্কা : বিসিবি সভাপতি একটি ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বলেছেন, ঢাকা লিগ আগের নিয়মে নিয়ে গেলে অল্প কিছু খেলোয়াড়ের লাভ, বাকিদের লোকসান। বিসিবি প্রধান যখন এই কথা বলেন তখন ক্লাবগুলোর ভবিষ্যতে সুযোগ নেওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।
দাবি ৩ : বিপিএল আগের নিয়মে নিতে হবে। বিদেশিদের সঙ্গে দেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের সামঞ্জস্য আনতে হবে।
বিসিবির অবস্থান : বিসিবি সভাপতি বলেন, আগামী মৌসুম থেকে তাই হবে। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রথায় বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেশিদের আয়ের সামঞ্জস্য আনা সম্ভব হবে না।
বাস্তবতা এবং শঙ্কা : আগামী মৌসুমে বিপিএল আগের মতো হলেও বাকি দাবি পূরণ হবে না। বিসিবি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নিয়মে বাঁধলে যা সম্ভব। এমনকি খেলোয়াড়দের নিজস্ব গ্রেড বেছে নেওয়ার প্রসঙ্গেই যায়নি বিসিবি। শঙ্কাটা স্পষ্ট, দেশের খেলোয়াড়রা প্রাধান্য পাবেন না।
দাবি ৪ : প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফি ১ লাখ, বেতন ৫০ শতাংশ বাড়ানো, বিভাগগুলোকে সুযোগ সুবিধায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা।
বিসিবির অবস্থান : বিসিবি সভাপতি বলেছেন না হয় বাড়ালাম কিছু ম্যাচ ফি। তার কথায় বেতন বাড়ানোয় প্রতিশ্রুতি নেই। বিভাগকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবির প্রতি আস্থাও নেই।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : বাস্তবতা হলো, উন্নত দেশ যখন ফার্স্ট ক্লাসকে আরও উন্নত করতে সুবিধা বাড়াতে থাকে তখন সেখানে কচ্ছপগতি বিসিবির। এখনো সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ও সর্বনিম্ন ১৭ হাজার টাকা বেতন খেলোয়াড়দের। চুক্তিভুক্ত মাত্র ৭৯ জন। খেলোয়াড়রা বঞ্চিত হতে থাকলে টেস্টের দুনিয়ায় উন্নতির সম্ভাবনাও তিমিরে থেকে যাবে।
দাবি ৫ : জাতীয় লিগে ভালো বল দেওয়ার, খেলোয়াড়দের অ্যালাউন্স বাড়ানো, ভ্রমণে বিমান সুবিধা, ভালো হোটেল, ভালো বাসের ব্যবস্থা করা।
বিসিবির অবস্থান : ‘এ আর এমন কি!’ কিন্তু এসব উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেননি বিসিবি সভাপতি।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : এই প্রয়োজন মেটাতে ভাণ্ডার উজাড় করে দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু ফিটনেসে বড় উন্নতি চাওয়া বিসিবি ২৫০০ টাকার ভ্রমণ, ১৫০০ টাকার দৈনিক ভাতায় তা কীভাবে আশা করে? এসবে উন্নতি হবে হয়তো। কিন্তু শঙ্কার জায়গা হলো বিষয়গুলোকে বোর্ডের এভাবে অবজ্ঞা করে যাওয়া।
দাবি ৬ : বিসিবির সঙ্গে চুক্তিভুক্ত জাতীয় খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করতে হবে। ২০১৭ সাল থেকে বেতন বাড়েনি। বেতন বাড়াতে হবে।
বিসিবির অবস্থান : বোর্ড মানবে না। বাড়াবে না। পাপনের সাফ কথা, আন্তর্জাতিকে ২০-২২ জন স্ট্যান্ডার্ড। তারা যথেষ্ট খেলোয়াড় রেখেছেন কেন্দ্রীয় চুক্তিতে। বেতন বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে এটাও মানার আশ্বাস নেই। যথেষ্ট দেয় বিসিবি, ঘোষণা তার।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : ‘এ প্লাস’-এর ৫ জন পান ৪ লাখ করে, ‘এ’ গ্রেডের ৩ জন ৩ লাখ করে, ‘বি’ গ্রেডের ৪ জন ২ লাখ করে, বাকি ৫ জন ১ লাখ করে। মাসে ৪২ লাখ। বছরে ৫ কোটি ৪ লাখ। বিসিবির মূল আয় এই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের কারণে। আইসিসি থেকে আনুমানিক ১৩-১৪ কোটি ডলার। টিভি রাইটসে বছরে ৩ লাখ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আয়ের আরও অনেক পথ। বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের বেতন উন্নত দেশগুলোর তুলনায় সামান্য। তাদের এই দাবিতে একমত না বিসিবি! চাহিদা না মিটিয়ে পারফরম্যান্স চাইলে সেটাই তো না পাওয়ার সবচেয়ে বড় শঙ্কা তৈরি করে।
দাবি ৭ : গ্রাউন্ডসম্যানদের সম্মানজনক বেতন, দেশের কোচ, ফিজিও, ট্রেনারদের বিদেশিদের ওপর প্রাধান্য দেওয়া ও ভালো বেতন নিশ্চিত করা।
বিসিবির অবস্থান : পাপনের কথা স্টাফদের সঙ্গে ওদের কী? তার মানে, এসব বিষয়ে খেলোয়াড়দের কথা বলা একদম পছন্দ না বিসিবির। দাবি তোলা তো তাহলে ঔদ্ধত্য। গ্রাউন্ডসম্যানদের বেতন বেশ বাড়ানো হয়েছে বললেও অন্যদের প্রসঙ্গে যাননি বিসিবি সভাপতি।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : বিপিএলে সব দলে বিদেশি প্রধান কোচ রাখার নির্দেশ দিয়ে বিসিবি দেশিদের পেছনে ঠেলে দেয়। এর সঙ্গে অন্যদের জুড়ে খেলোয়াড়রা সবার জন্য সম্মান নিশ্চিত করার যে দাবি তুলেছে তাতে আদৌ ভ্রুক্ষেপ নেই বিসিবির। শঙ্কা হলো, খেলোয়াড়রা খেলা বন্ধ করে এসব দাবি তুললেও যখন তাতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না পাপনরা তাহলে ফিরলে দেবেন?
দাবি ৮ : বাড়তি একটা করে ঘরোয়া ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে।
বিসিবির অবস্থান : পাপনের প্রশ্ন জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা খেলবে? খেললে চারটা আয়োজন করব। দাবি আদায় করে খেলবে না, এসব ভং চলবে না।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : দাবিটা স্রেফ উড়িয়ে দিলেন বিসিবি সভাপতি। অথচ খেলা বেশি মানে খেলোয়াড়দের মাঠের বাইরে না থাকা। বিসিবি সভাপতি যখন এমন বলেন খেলোয়াড়দের শঙ্কা কাটার উপায় থাকে না তখন।
দাবি ৯ : বিসিবি নির্ধারিত একটা বাৎসরিক ক্যালেন্ডার করে দেবে যাতে খেলোয়াড়রা সবসময় তৈরি থাকতে পারে।
বিসিবির অবস্থান : এই পয়েন্টে যাননি বিসিবি সভাপতি।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : প্রশ্নবিদ্ধ বিসিবির ইচ্ছা। তারা দাবি মানবে সব, আগে আসলে মেনে নিত। কিন্তু অধিকাংশ দাবিতে তাদের নিজস্ব যুক্তি ।
দাবি ১০ : ঢাকা লিগের পারিশ্রমিক ক্লাবগুলো যেন নির্দিষ্ট সময়ে মিটিয়ে দেয় তা নিশ্চিত করা।
বিসিবির অবস্থান : বিসিবি নিজের উদ্যোগেও আগে খেলোয়াড়দের টাকা মিটিয়েছে। তারা নিশ্চিত করছে, একটি ক্লাব বাকি রাখলেও তা মেটানো হবে। যদিও এটা ক্লাব ও খেলোয়াড়দের ব্যাপার বলে মানে তারা।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : এই জায়গাটায় বিসিবিকে প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু তাদের দরজায় আগামীতেও খেলোয়াড়দের বারবার ঘুরতে যে হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
দাবি ১১ : জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের খেলা না থাকলে দুটির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে দিতে হবে।
বিসিবির অবস্থান : দাবিটা ফরহাদ রেজার কাছ থেকে উঠেছিল বলে খুব বিদ্রƒপ করে নিলেন পাপন। এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলে না বোর্ড।
বাস্তবতা ও শঙ্কা : আন্দোলনটা সব খেলোয়াড়ের, শুধু জাতীয় দলের না। সেখানে অভিভাবক এমন বিদ্রুপ করলে খেলোয়াড়দের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়।
** গতকাল সন্ধ্যায় আরও দুটি দাবি সংযোজন করেছেন আন্দোলনরত ক্রিকেটাররা- ১২. ক্রিকেট বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ১৩. বিসিবির রাজস্বের একটি ন্যায্য ভাগ পুরুষ ও নারী ক্রিকেটারদের দিতে হবে।