বছরে দেশে ৪০ হাজার কিডনি রোগী মারা যায়, অথচ সরকারী হাসপাতালগুলোতে অধ্যাপক পর্যায়ের কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ
(কোভিড-১৯) করোনা ভাইরাসে যখন বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব আক্রান্ত সেই সময় বাংলাদেশে বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা।
কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ৪০ হাজার রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। ‘মরনোত্তর অঙ্গদান ও সংযোজন’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য জানান। কিডনি ফাউন্ডেশন, সোসাইটি অব অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন বাংলাদেশ, কোরিয়ান সোসাইটি ফর ট্রান্সপ্লান্টেশন এবং বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের সহযোগীতায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১৯৮২ সাল থেকে দেশে কিডনি সংযোজন ও ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে। এখানে শতভাগ কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয় জীবিত নিকটাত্মীয়ের দেহ থেকে কিডনি বিযুক্ত করে। অঙ্গদাতা বা ডোনার সংকটের কারণে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে হাজার হাজার কিডনি বিকল রোগী। এর মধ্যে ২০ ভাগ কিডনি রোগের চিকিৎসা পেলেও বাকী ৮০ ভাগ চিকিৎসা সেবার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এছাড়া কয়েক হাজার মানুষ লিভার, হার্ট, ফুসফুস, অগ্নাশয় ইত্যাদি বিকল হয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বে ৬০/৭০ ভাগের বেশি কিডনি বিকল মানুষ মরনোত্তর অঙ্গদান প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা নিয়ে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। বাংলাদেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইনে কোন বাধা না থাকলেও সচেতনতার যথাযথ জ্ঞানের অভাবে এখনো মরনোত্তর অঙ্গদান শুরুই করা যায় নি। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে এই চিকিৎসা চালু হলে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে অনেক রোগীকে রক্ষা করা সম্ভব হত।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশের প্রায় দুই কোটি কিডনি রোগীর উন্নত সেবার জন্য দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ৪৪টি জেলা সদর হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস এবং নেফ্রোলজি ইউনিট স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য ২৫৫.২২ কোটি টাকা একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমাদের গবেষনায় দেখা গেছে, কিডনি ডায়ালাইসিস শুরু করেছেন এমন ৭৫ শতাংশ রোগী খরচ বহন করতে না পেরে ছয় মাসের মধ্যেই ডায়ালাইসিস নেওয়া বন্ধ করে দেন। ব্যায়বহুল এই চিকিৎসা চালানো অধিকাংশ কিডনি রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না। তাঁরা অকালেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে।
কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, কিডনি রোগ একটি সর্বনাশা রোগ। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আগে থেকেই প্রতিরোধ করতে হবে; সচেতন থাকতে হবে। তাঁরা বলেন, কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কিডনি ৭০ শতাংশ ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কোন লক্ষণ দেখা যায় না। রোগীরা বুঝতেই পারেনা যে তার কিডনির সমস্যা আছে। কিডনি সমস্যার প্রধান কারন হিসেবে ডায়াবেটিসকে উল্লেখ করেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে যাদের ডায়াবেটিস আছে অথবা পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে এবং উচ্চ রক্তচাপ আছে বা পরিবারে কারও থাকলে, এমনকি পরিবারে কোন কিডনিরোগী থাকলে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য্য কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ রফিকুল আলম বলেন দেশে মোট রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা একেবারে অপ্রতুল, ফলে বিনা চিকিৎসায় মারা যান অধিকাংশ কিডনি রোগী। অধ্যাপক ডাঃ রফিকুল আলম বলেন আমাদের দেশে যত রোগীর ডায়ালাইসিস দরকার তারমধ্যে মাত্র ১০ থেকে ২০% ডায়ালাইসিস সুবিধা পায়, তাদের মধ্যে আর্থিক সংকটের কারনে ৬ মাস পরে অধিকাংশই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না।
তবুও ঢাকাস্থ সরকারী হাসপাতালগুলোতে ডায়ালাইসিস সুবিধা দরিদ্র রোগীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে যদিও বেড সংখ্যা অপ্রতুল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনি বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ জন কিডনি রোগী ৩ শিফটে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন নূন্যতম ব্যয়ে। এই বিভাগে ছিলেন মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ নিজাম উদ্দিন চৌধুরী যিনি ২ মাস আগে অবসরে গেছেন। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কিডনি বিভাগকে ঢেলে সাজাতে। ডাঃ চৌধুরীর অবসরের পর এখন একজন অধ্যাপকও নেই এই বিভাগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মত দেশের সর্ববৃহৎ এই হাসপাতালে। সহযোগী অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন যা তাঁর একার পক্ষে পরিচালনা করা অসম্ভব। এই চিত্র সারা দেশের সবকয়টি সরকারী হাসপাতালগুলোতে, কোথাও অধ্যাপক নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমি চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় অধ্যাপক ডাঃ মোঃ নিজামউদ্দিন চৌধুরীর অবসরের পর দৈনিক সংবাদ কণিকার সম্পাদক হিসেবে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ১৫/১/২০২০ তারিখে পত্রযোগে অনুরোধ করেছিলাম যেহেতু মুজিববর্ষে কিডনি রোগের চিকিৎসার উপর সরকার জোর দিচ্ছেন সেহেতু অধ্যাপক ডাঃ মোঃ নিজামউদ্দিন চৌধুরী সহ যে ৫ জন অধ্যাপক অবসরে গেছেন বা যাচ্ছেন তাদের ২ বৎসরের জন্য পুনর্নিয়োগ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির ব্যবস্থা করুন। নাহলে সরকারের এই কিডনি চিকিৎসার প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমনকি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও কিডনি রোগের চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না।
যারা অবসরে গেছেন তাদের কোন আর্থিক ক্ষতি নেই; তাঁরা চেম্বারেই প্রচুর রোগী দেখেন; কিন্তু দরিদ্র রোগী যারা সরকারী হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল তারা কি ১২০০/০০ টাকা ফি দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে পারবেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার দৃষ্টিতে অনেক অসঙ্গতিকে কেউ তুলে ধরে না। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ৫/৬ জন অধ্যাপককে ২ বৎসরের জন্য পুননিয়োগ দিলে সরকার তথা জাতিই উপকৃত হতো। দুই বছরের মধ্যে তাঁরা কমপক্ষে ২০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে পারতেন যারা সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল গুলোতে কিডনি রোগীদের সেবা দিতে পারতেন!
সরকারের অনেক নন-টেকনিক্যাল পদে অবসরের পর পুর্ণনিয়োগ দেয়া হয়, অথচ চিকিৎসকের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল পদে পুর্ণনিয়োগ দেয়া দিতে বাধা কোথায় তা আমাদের মাথায় আসেনা। শুধু তাই নয়, নেফ্রোলজি বিভাগে উপযুক্ত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যারা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন তাদের পদোন্নতি দিয়ে অধ্যাপক করলেও কিছুটা ঘাটতি পূরণ হত।
লেখকঃ মোঃ আনিসুর রহমান, সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ কণিকা